রবিবার, ৪ জুলাই, ২০২১

 একজন মু‌মিন ও এল‌মে তাসাউফ 

 একজন মু‌মিন ও এল‌মে তাসাউফ 

মু‌মিন হিসা‌বে জীবণ গ‌ড়ে তোলার ক্ষে‌ত্রে এল‌মে তাসাউ‌ফের ঞ্জান থাকাটা অত্যাবশ্য‌কিয়। 

এলমে তাসাউফ কাকে বলে ? এর উৎপত্তি কখন থেকে ?

 ** যে বিজ্ঞান চর্চা করলে মানুষ সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ তায়ালার পরিচয় লাভের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে উত্তম চরিত্রে চরিত্রবান হয়ে আল্লাহ্‌র প্রতিনিধি বা খলিফাতুল্লাহ্‌র মর্যাদায় পৌঁছতে পারে, তাকে এল্‌মে তাসাউফ বলে । এল্‌মে তাসাউফের সাহায্যে মানুষ স্রষ্টা ও সৃষ্টি সম্পর্কিত মহাজাগতিক সব বিষয় সম্বন্ধে অবহিত হয়ে আশরাফুল মাখলুকাতের গুণাবলী অর্জন করে । এভাবেই সে আল্লাহ্‌র প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা লাভ করতে পারে । 

বস্তুতঃ যে বিজ্ঞান মানুষকে উত্তম চরিত্র গঠন করতে সাহায্য করে আল্লাহ্‌র পরিচয় লাভ করতঃ তাঁর সাথে যোগাযোগ স্থাপনের পথ দেখায় এবং যার মাধ্যমে আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসুল (সঃ)-এর বিধান মোতাবেক শান্তিময় জীবন পরিচালনার শিক্ষা লাভ করা যায়, তাকে এল্‌মে তাসাউফ বলে । 

এল্‌মে তাসাউফকে এল্‌মুল ক্বালব, এল্‌মে মুকাশাফা, এল্‌মে লাদুন্নী, তাজকিয়ায়ে নফ্‌স প্রভৃতি নামেও অভিহিত করা হয় । তাসাউফের সাধনার মাধ্যমেই সমস্ত নবী-রাসুল-আওউলিয়ায়েকেরাম আল্লাহ্‌র পরিচয় লাভ করে সুসংবাদ প্রাপ্ত হয়েছেন । এলমে তাসাউফ পৃথিবীর আদিমতম স্বর্গীয় মৌলিক জ্ঞান- যা মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা প্রথম মানব হযরত আদম (আঃ)-কে নিজে শিক্ষা দিয়েছিলেন । পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- অর্থ-"আর তিনি (আল্লাহ্‌) আদমকে সব কিছুর নামের জ্ঞান দেয়ার পর ফেরেশতাদের সামনে হাজির করলেন" (সুরা- বাকারা, আয়াত- ৩১) । ঐ জ্ঞানের বলেই হযরত আদম (আঃ) ফেরেশতাদের চেয়ে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন প্রমাণিত হলেন এবং আল্লাহ্‌র যোগ্য প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেন । মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা নিজে যে পদ্ধতিতে হযরত আদম (আঃ)-কে জ্ঞান দান করেছিলেন, তা-ই তাসাউফ । ঐ পদ্ধতিতে জ্ঞান অর্জন করেই হযরত আদম (আঃ) হতে হযরত মোহাম্মদ (সঃ) পর্যন্ত সমস্ত নবী-রাসুল আল্লাহ্‌র পরিচয় লাভ করতঃ তাঁর সাথে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে মানুষের কাছে তাওহীদের বাণী প্রচার করেছেন । বিশ্ব নবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) একাধারে পনর বছর হেরা গুহায় তাসাউফের সাধনা তথা মোরাকাবা করার পর যখন তিনি চল্লিশ বছর বয়সে উপনীত হন, তখন আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে জিব্রাইল (আঃ)-এর মাধ্যমে রেসালাতের বাণী লাভ করেছেন । তা হযরত মোহাম্মদ (সঃ)-এর জন্য তাসাউফ সাধনার ফসল । পরবর্তীতে তিনি এল্‌মে তাসাউফের সাহায্যেই বর্বর আরব জাতিকে একটি আদর্শ জাতিতে পরিণত করেছিলেন । তাসাউফের জ্ঞান দিয়ে হযরত নূহ (আঃ) আল্লাহ্‌র সাথে কথোপকথন করেছিলেন । তাসাউফের জ্ঞানে জ্ঞানী বলে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) আগুনে নিক্ষিপ্ত হয়েও অক্ষত অবস্থায় রক্ষা পেয়েছিলেন; হযরত দাউদ (আঃ) পশু-পাখীর ভাষা বুঝতেন; হযরত সুলায়মান (আঃ) আকাশ পথে উড়ে বেড়াতেন; হযরত মুসা (আঃ) লাঠির আঘাতে নীলনদের পানিতে রাস্তা করে দিয়েছিলেন; হযরত ঈসা (আঃ) মৃতকে জীবিত করেছিলেন; হযরত মোহাম্মদ (সঃ) আরব জাতিকে অন্ধকার যুগে আলো দান করে তাদেরকে সুসভ্য ও সমৃদ্ধশালী জাতিতে পরিণত করেছিলেন; শাহাদাৎ অংগুলী মোবারকের ইশারায় তিনি চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করেছিলেন; কেয়ামত, হাশর, মিজান, পুলসিরাত, কবরের আজাব ইত্যাদিসহ রহস্য জগতের অসংখ্য বিষয়ের বর্ণনা তিনি দিয়েছিলেন । আর এল্‌মে তাসাউফের সাহায্যেই বেলায়েতের যুগে বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) বার বছর পূর্বে নৌকাডুবে নদীতে মৃত্যুবরণকারী বরযাত্রীসহ বর-বধূকে জীবিত করেছিলেন; হযরত খাজা মইনুদ্দীন চিশ্‌তী (রহঃ) একটি ঘটিতে পানি তুলে 'আনা সাগর' শুকিয়ে দিয়েছিলেন; হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী (রহঃ) বাদশাহ্‌ আকবরের 'দ্বীনে-এলাহী'-কে তছনছ করে দিয়েছিলেন; হযরত শাহ্‌জালাল (রহঃ) জায়নামাজ বিছিয়ে সুরমা নদী পার হয়েছিলেন; ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহঃ) অন্ধের চক্ষু ভালো করে দিয়েছিলেন । প্রকৃতপক্ষে, এলমে তাসাউফ আল্লাহ্‌কে প্রত্যক্ষভাবে জানার বিজ্ঞান । শরীয়ত হচ্ছে ইসলাম ধর্মের বাহ্যিক আচার-আচরণ সম্পর্কিত দিক-নির্দেশনা, আর তাসাউফ হচ্ছে আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভের আত্মিক উপায় । এল্‌মে তাসাউফ ইসলাম ধর্মের সে বিজ্ঞানময় দিক শিক্ষা দিয়ে আসছে, যে বিজ্ঞানের সাহায্যে অন্তরচক্ষু দিয়ে স্রষ্টার দর্শন লাভ করা সম্ভব । স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে যে বিভেদকারী পর্দা রয়েছে এলমে তাসাউফের অনুশীলনে সে পর্দা অপসারিত হয়ে যায় । ফলে মহিমান্বিত আল্লাহ্‌ তায়ালার একক সত্তা বাস্তবে উপলব্ধি করা যায় । সুতরাং এল্‌মে তাসাউফ হচ্ছে ইসলামের প্রাণ । সেখান থেকেই ইসলাম ধর্মের মূল শক্তি উৎসারি। সমগ্র সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত মানব জাতির জন্য তাঁর প্রভুর পরিচয় জানা এবং প্রভুর ইচ্ছা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা অতীব প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ । আর এর মধ্যেই মানব জাতির চির শান্তি, কল্যাণ ও সমৃদ্ধি নিহিত রয়েছে । ইসলাম মানব জাতির পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান । একজন মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কিভাবে জীবন পরিচালনা করতে হবে, এর বিধি-বিধান এতে রয়েছে । আর এ শান্তিময় জীবন-বিধানকে কার্যকরী করার জন্য প্রয়োজন তাসাউফের চর্চা । পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- অর্থ-"সে সফলতা লাভ করেছে, যে পবিত্রতা অর্জন করেছে ও প্রভুর জিকির করে অতঃপর নামাজ কায়েম করে" (সূরা- আ'লা; আয়াত- ১৪-১৫) । অন্যত্র এরশাদ হয়েছে- অর্থ-"যেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি কোন উপকারে আসবে না (সেদিন উপকৃত হবে সে) যে আল্লাহ্‌র কাছে বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ নিয়ে আসবে" (সুরা- শু'য়ারা, আয়াত- ৮৮-৮৯) । মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা আরও এরশাদ করেন- অর্থ-"যে ব্যক্তি আত্মাকে পুতঃপবিত্র রাখল, সে সফলতা লাভ করল । আর যে ব্যক্তি আত্মাকে কলুষিত করল সে ব্যর্থ হয়ে গেল" (সূরা- আশ্‌-শামস, আয়াত- ১০-১১) । হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত রাসুল (সঃ) ফরমান- অর্থ-"সাবধান! নিশ্চয়ই মানুষের দেহের ভিতরে এমন এক টুকরা মাংস আছে, সে মাংস টুকরা যখন যথার্থরূপে পবিত্র হয়, তখন সমস্ত দেহই পবিত্র হয়; আর সে মাংস টুকরা যখন অপবিত্র হয়ে পড়ে, তখন সমস্ত দেহই অপবিত্র হয়ে যায়; আর তা হলো- ক্বালব (হৃদপিণ্ড)" (বোখারী শরীফ) । কাজেই আদর্শ মানুষে পরিণত হওয়ার জন্য প্রয়োজন পবিত্র অন্তঃকরণ ও আদর্শ চরিত্র । আর একমাত্র এলমে তাসাউফই তা মানুষকে শিক্ষা দিয়ে থাকে । এল্‌মে তাসাউফের অনুশীলন ছাড়া কোন ইবাদত একাগ্রতার সাথে সঠিকভাবে পালন করা যায় না । তাছাড়া মানুষ আল্লাহ্‌র প্রতিনিধি বা বিশ্বের সেরা সৃষ্টির মর্যাদাও পেতে পারেন । বস্তুতঃ তাসাউফ চর্চার মাধ্যমে মানুষের প্রকৃত গুণাবলী অর্জন করা সহজ হয় । এর মাধ্যমে মানুষের প্রকৃত মর্যাদা, আল্লাহ্‌র প্রতিনিধিত্ব করার জন্য মানুষের গুণাবলী এবং ঐ গুণাবলী অর্জন করার কৌশল সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায় । প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ)-এর আবির্ভাবকালে সমগ্র পৃথিবীর মানুষের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয় । বিশেষ করে আরববাসীরা তখন শিক্ষা-সংস্কৃতি, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এতই অধঃপতিত অবস্থায় ছিল যে, তাদের ঐ যুগ ইতিহাসে আইয়ামে জাহেলিয়াত বা অজ্ঞতার যুগ হিসেবে পরিচিত । সে সময় আরবের লোকেরা আল্লাহ্‌কে ভুলে অগ্নিপূজা, মূর্তিপূজা নানাবিধ পাপাচারে লিপ্ত ছিল । কিন্তু হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এলমে তাসাউফের শিক্ষা দিয়ে বর্বর আরবদেরকে একটি আদর্শ জাতিতে পরিণত করেছিলেন । ইসলাম-পূর্ব যুগে যে আরবরা সারা বছরই ঝগড়া-বিবাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, হত্যা-ব্যভিচার প্রভৃতি যাবতীয় পাপাচারে লিপ্ত ছিল, ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে তারাই সুসভ্য, সুসংগটিত, সমৃদ্ধ ও উন্নত জাতিতে পরিণত হয়েছিল । হযরত মোহাম্মদ (সঃ)-এর তাসাউফের শিক্ষা পেয়ে আরবের নও-মুসলিমরা পারস্পারিক স্নেহ-মায়া-মমতা, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, সহযোগিতা-সহমর্মিতায় এতই উদ্দীপিত হয়ে উঠেছিল যে, অতি অল্প সময়েই তাঁরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন । হযরত মোহাম্মদ (সঃ) প্রদত্ত এল্‌মে তাসাউফের শিক্ষা লাভ করে মুসলিম জাতি শিক্ষা-সংস্কৃতি, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব সাফল্য নিয়ে আসে । ফলে তখন পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চল মুসলমানদের ভাবধারায় প্রভাবিত হয় এবং মানুষ দলে দলে ইসলামকে শান্তির ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে । তাছাড়াও মুসলমানদের মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বিশেষ উন্নতি সাধিত হয়ে ইসলামী সভ্যতা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে প্রসারিত হয় । কিন্তু একথা দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ইসলামের মৌলিক শিক্ষা তথা এলমে তাসাউফের চর্চার মাধ্যমে মুসলিম জাতি আল্লাহ্‌র শক্তিতে বলীয়ান হয়ে আদর্শ চরিত্র অর্জন করে যে ঐতিহ্য ধারণ করেছিল, পরবর্তী যুগে এল্‌মে তাসাউফের শিক্ষা ছেড়ে দেয়ার ফলে তাঁরা নিজেদের গৌরবময় ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে । আজ এল্‌মে তাসাউফের চর্চার অভাবে মুসলিম জাতি প্রকৃত ইসলামী আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে বিধর্মীদের হাতে নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে । তবে আওউলিয়ায়েকেরাম পৃথিবীর যেখানে গিয়ে এলমে তাসাউফের শিক্ষার প্রচলন করেছেন, সেখানেই ইসলামের আদর্শ পুনরুজ্জীবিত হয়ে মুসলমানরা তাদের জীবনের সঠিক পন্থা,উন্নতি ও সমৃদ্ধি লাভ করেছেন । আজ আমরা বাহ্যতঃ ইসলামের অনুসরণ করি অথচ আমাদের মাঝে শান্তি নেই; আমরা ইবাদত-বন্দেগী করেও কোন রকম সুফল পাচ্ছি না; সারা বিশ্বে আমরা মুসলমানরা বিধর্মীদের হাতে নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছি । এর মূল কারণ- ইসলামের মৌলিক শিক্ষা এল্‌মে তাসাউফের চর্চা আমরা ছেড়ে দিয়েছি । এ উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার হয়েছে আওউলিয়ায়েকেরামের মাধ্যমে, যাঁদের শিক্ষার মূল ভিত্তি ছিল এল্‌মে তাসাউফ । একমাত্র খাঁটি আওউলিয়ায়েকেরামই এল্‌মে তাসাউফের জ্ঞান দিয়ে মানুষকে পরিপূর্ণভাবে ইসলামী শিক্ষা দিতে পারেন । আমাদের পূর্ব-পুরুষগণ হযরত মোহাম্মদ (সঃ)-এর আদর্শের ধারক-বাহক আওলিয়ায়েকেরামের সাহচর্যে গিয়ে এল্‌মে তাসাউফের চর্চার মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষা যথাযথভাবে অনুসরণ করে আদর্শ চরিত্রের অধিকারী হতে পারি, তবেই আমাদের দৈন্যদশা ঘুচিয়ে মুসলিম জাতির হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করা সম্ভব । মহান সংস্কারক, জগতশ্রেষ্ঠ তাসাউফ বিজ্ঞানী, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (মাদ্দাজিল্লুহুল আলী) হুজুর কেবলা এল্‌মে তাসাউফ সম্পর্কে বলেন-"যে বিজ্ঞান সাধনা করলে আল্লাহ্‌কে জানা যায়, আল্লাহ্‌র পরিচয় লাভ করা যায়, আল্লাহ্‌কে দেখা যায়, আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে নির্দেশ পাওয়া যায় ও আদর্শ চরিত্রবান হওয়া যায় তাকে এলমে তাসাউফ বলে । আর এই এলমে তাসাউফের বিদ্যায় বিদ্বান ছিলেন বলেই নবী-রাসুল ও আউলিয়ায়েকেরাম আল্লাহ্‌র সাথে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে সমকালীন জামানার মানুষকে আদর্শ চরিত্রবান করে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন । মানব জাতি আজ তাঁদের অনুসরণ ছেড়ে দেয়ার ফলেই বিশ্বজুড়ে অশান্তির সৃষ্টি হয়েছে ।" পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফের আলোকে উপরোক্ত আলোচনা থেকে পরিশেষে বলা যায় যে, মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা হযরত আদম (আঃ) হতে এ পৃথিবীতে আগত সমস্ত নবী, রাসুল ও মহামানবকে যে বিশেষ জ্ঞান দান করেছিলেন, উহাই হলো এলমে তাসাউফ । ইহাই ঐ বাতেনী জ্ঞান, যার সাহায্যে মানুষ আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জন করে আল্লাহ্‌ তায়ালার নৈকট্য লাভ করতঃ স্রষ্টা ও সৃষ্টি জগতের সমস্ত ভেদ ও রহস্য উন্মোচন করে আশরাফুল মাখলুকাতের গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ তায়ালার খলীফার মর্যাদায় উপনীত হতে পারে । 

আল্লাহ্‌ কোন পথে ? 

 তাসাউফের পরম সত্য

 তাসাউফ হলো সচ্চরিত্র বা সৎ স্বভাবের নাম। মানুষ সৎভাবে যত অগ্ৰগামী হবে,তার তাসাউফ ততটা বৃদ্ধি পাবে। তেমনিভাবে আখলাক বা সৎস্বভাবের অংশ দুটি: 

প্রথমটি স্রষ্টার সঙ্গে সৎস্বভাব, দ্বিতীয়টি সৃষ্টির সাথে সদ্ব্যবহার । 

ক. আল্লাহর সাথে সদ্ব্যবহার বা সৎস্বভাবের অর্থ এই যে, বান্দা আল্লাহর বিধানের উপর সন্তুষ্ট থাকবে। তার কোন কাজ বা সিদ্ধান্তের উপর। অভিযােগ করবে না। তাঁর প্রতিটি কাজ বা সিদ্ধান্ত বিনা দ্বধায় মেনে নিতে হবে।

 খ. সৃষ্টির সঙ্গে সদ্ব্যবহারের অর্থ এই যে, সৃষ্টির সাথে তার সম্পর্কের কারণে যে দায়িত্ব তার উপর অর্পিত হয়, তা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই পালন করবে। এতে অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকবে না। 

হযরত মারতাআশ (রহঃ) বলেন, 'সৎস্বভাবের নামই হলো তাসাউফ, এটা তিন প্রকার। 

১. প্রথমত, মহান আল্লাহর সাথে সদ্ব্যবহার: অর্থাৎ তার যাবতীয় আহকাম সন্তুষ্ট চিত্তে বিনা বাক্যব্যয় পালন করা। 

২. দ্বিতীয়ত, সৃষ্টির সাথে সদ্ব্যবহার: অর্থাৎ বয়স্কদেরকে সম্মান করা, ‌ছোট‌দের‌কে স্নেহ করা এবং সমবয়স্কদের সঙ্গে সমান ব্যবহার করা। কিন্তু এর বিনিময়ে অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারবে না।

 ৩. তৃতীয়, সৎস্বভাব হলো এই যে, শয়তান ও কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে বিরত থাকতে হবে। আট প্রকার চরিত্র নিয়ে তাসাউফ গঠিত। যথা: সাখাওয়াত,রেযা,সবর,ইশরাত,গুরবাত,পশমী পোশাক,সিয়্যাহাত এবং আল-ফাকরু বা ফকী‌রি । 

.সাখাওয়াত(দানশীলতা): এর নির্দেশন হলেন হযরত ইব্রাহীম(আঃ)। তিনি তার জীবন ও তার স্নেহের পুত্র কে স্রষ্টার পথে উৎসর্গ করে দিয়েছেন। কোরআনে আছে, সূরাঃ আল-হুজুরাত [৪৯:১৫] إِنَّمَا ٱلْمُؤْمِنُونَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا۟ وَجَٰهَدُوا۟ بِأَمْوَٰلِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ أُو۟لَٰٓئِكَ هُمُ ٱلصَّٰدِقُونَ ইন্নামাল মু’মিনূনাল্লাযীনা আ-মানূবিল্লা-হি ওয়া রাছূলিহী ছুম্মা লাম ইয়ারতা-বূওয়া জাহাদূবিআমওয়া-লিহিম ওয়া আনফুছিহিম ফী ছাবিলিল্লা-হি উলাইকা হুমুসসা-দিকূন। "তারাই মুমিন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করে না এবং আল্লাহর পথে প্রাণ ও ধন-সম্পদ দ্বারা জেহাদ করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ"। সূরাঃ আল-বাকারা [২:২৭৪] ٱلَّذِينَ يُنفِقُونَ أَمْوَٰلَهُم بِٱلَّيْلِ وَٱلنَّهَارِ سِرًّا وَعَلَانِيَةً فَلَهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ আল্লাযীনা ইউনফিকূনা আমওয়া-লাহুম বিল্লাইলি ওয়ান্নাহা-রি ছিররাওঁ ওয়া‘আলা-নিইয়াতান ফালাহুম আজরুহুম ‘ইনদা রাব্বিহিম ওয়ালা-খাওফুন ‘আলাইহিম ওয়ালা-হুম ইয়াহঝানূন। "যারা স্বীয় ধন-সম্পদ ব্যয় করে, রাত্রে ও দিনে, গোপনে ও প্রকাশ্যে। তাদের জন্যে তাদের সওয়াব রয়েছে তাদের পালনকর্তার কাছে। তাদের কোন আশংঙ্কা নেই এবং তারা চিন্তিত ও হবে না"। 

 ২. রেযা (আল্লাহর সন্তুষ্টি): এর নিদর্শন হলেন হযরত ইসমাঈল (আঃ)। তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে স্বীয় জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। 

 ৩. সবর (ধৈর্য): এর প্রতীক হলেন হযরত আইউব (আঃ)। তিনি আল্লাহর মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রেখে নিজের চোখের সামনে পরিবারের সবাইকে ধ্বংস হতে দেখে এবং নিজের সর্বাঙ্গ কীট ও পােকায় খেয়ে ফেলার কষ্ট সত্ত্বেও সীমাহীন ধৈর্যধারণ করেছেন । কোরআনে আছে, সূরাঃ আর-রাদ [১৩:২৪] سَلَٰمٌ عَلَيْكُم بِمَا صَبَرْتُمْ فَنِعْمَ عُقْبَى ٱلدَّارِ ছালা-মুন ‘আলাইকুম বিমা-সাবারতুম ফানি‘মা ‘উকবাদ্দা-র। "বলবেঃ তোমাদের ধৈর্যের কারণে তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। আর তোমাদের এ পরিণাম-গৃহ কতই না চমৎকার"। সূরাঃ আল-আদিয়াত [১০০:৬] إِنَّ ٱلْإِنسَٰنَ لِرَبِّهِۦ لَكَنُودٌ ইন্নাল ইনছা-না লিরাব্বিহী লাকানূদ। "নিশ্চয় মানুষ তার পালনকর্তার প্রতি অকৃতজ্ঞ"। সূরাঃ আল-বাকারা [২:১৫২] فَٱذْكُرُونِىٓ أَذْكُرْكُمْ وَٱشْكُرُوا۟ لِى وَلَا تَكْفُرُونِ ফাযকুরূনী আযকুরকুম ওয়াশকুরূলী ওয়ালা-তাকফুরূন। "সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ রাখবো এবং আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর; অকৃতজ্ঞ হয়ো না"। 

 ৪. ইশারাত (ইঙ্গিত): এর নিদর্শন হলেন যাকারিয়া (আঃ)। তিনি আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং বেশ কিছু দিন ইশারায় কথাবার্তা বলতেন। 

 ৫. গুরবাত (অপরিচিত হওয়া ): এর উদাহরণ হযরত ইয়াহইয়া (আঃ)। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তিনি নিজ দেশে আত্মীয়-স্বজনের। নিকটও অপরিচিত ছিলেন। 

 ৬. পশমের পোশাক পরিধান -এর নিদর্শন হলেন হযরত মূসা (আঃ)। তিনি পশমের ‌পোষাক পরিধান করতেন।

 ৭. সিয়্যাহাত (ভ্রমণ): এর উদাহরণ হলেন হযরত ঈসা (আঃ)। তিনি একটি পেয়ালা ও একটি চিরুণী নিয়ে গৃহ ত্যাগ করেন। পথিমধ্যে তিনি একজনকে পেয়ালার পরিবর্তে অঞ্জলী দ্বারা পানি পান করতে দেখে পেয়ালা ফেলে দিলেন। অপর একজনকে চিরুণীর পরিবর্তে অঙ্গুলী দ্বারা চুল বিন্যাস করতে দেখে চিরুণীও ফেলে দিয়েছিলেন। 

 ৮.ফকীরি (দরিদ্রতা): এর নিদর্শন হলেন হযরত মুহাম্মদ(সাঃ)। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও জাকজমকভাবে জীবন যাপন করার জন্য আল্লাহ্ তাঁর হাতে পৃথিবীর যাবতীয় ধন-সম্পদের চাবি তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি একদিন পেট ভরে খাওয়া এবং দু'দিন অনাহারে থাকাই অধিক পছন্দ করতেন।অধিক সময় তিনি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করতেন, হে আল্লাহ্ ! তুমি আমাকে দরিদ্র অবস্থায় জীবিত রাখ, দরিদ্ররূপেই মৃত্যুদান করো এবং দরিদ্রদের সাথেই আমাকে হাশরে উঠাও। সূরাঃ বনি ইসরাইল/আল ইসরা [১৭:৭২] وَمَن كَانَ فِى هَٰذِهِۦٓ أَعْمَىٰ فَهُوَ فِى ٱلْءَاخِرَةِ أَعْمَىٰ وَأَضَلُّ سَبِيلًا ওয়া মান কা-না ফী হা-যিহীআ‘মা-ফাহুওয়া ফিল আ-খিরাতি আ‘মা- ওয়া আদাল্লু ছাবীলা-। "যে ব্যক্তি ইহকালে অন্ধ ছিল সে পরকালেও অন্ধ এবং অধিকতর পথভ্রান্ত"। 

যুগ যুগ ধ‌রে বাংলা‌দে‌শ তথা উপমহা‌দে‌শে ইল‌মে তাসাউফের ঞ্জান দ্বারা ইসলা‌মের ঝান্ডা সুউচ্চ স্থা‌নে যারা তু‌লে ধ‌রে আল্লাহ ও রাসু‌লের প‌থে মানুষ‌কে দীক্ষা দি‌য়ে জীবণ‌কে সুন্দরভা‌বে প‌রিচা‌লিত কর‌ছেন তাঁরা হ‌লেন ও‌ল‌ী আও‌লীয়ারা ও পীর মু‌র্শিদগন। 

 - জা‌হিদ আহ‌মেদ ও তার স্মৃ‌তি প‌রিষদ ।

 (**) তথ্যসূত্র : কাশফুল মাহজুব বই সহ অন্যান্য ইসলা‌মিক বই । 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সালাত আদায় ও অতপর :

 সালাত আদায় ও অতপর : ---------------------------------------- বেশ কিছুদিন আগে , ঢাকার সংসদ ভবন রো‌ডে আসাদ‌ গেইট যাওয়ার প‌থে বা‌সে ব‌সে‌ছি‌ল...