সোমবার, ২৯ মার্চ, ২০২১

শবে বরাত বা নিসফে শাবান পাল‌নে কুরআন ও বুযুর্গ‌দের ‌দৃ‌ষ্টি‌তে যৌ‌ক্তিকতা

শবে বরাত বা নিসফে শাবান পাল‌নের কুরআন ও বুযুর্গ‌দের ‌দৃ‌ষ্টি‌তে যৌ‌ক্তিকতা

শবে বরাত বা মধ্য-শা'বান (আরবি: نصف شعبان‎, প্রতিবর্ণী. নিসফে শাবান‎) বা লাইলাতুল বরাত হচ্ছে হিজরী শা'বান মাসের ১৪ ও ১৫ তারিখের মধ্যবর্তী রাতে পালিত মুসলিমদের গুরুত্বপূর্ণ রাত। উপমহাদেশে এই রাতকে শবে বরাত বলা হয়। ইসলামী বিশ্বাস মতে, এই রাতে আল্লাহ তার বান্দাদেরকে বিশেষভাবে ক্ষমা করেন। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের অনেক মুসলমান নফল ইবাদাতের মাধ্যমে শবে বরাত পালন করেন। অনেক অঞ্চলে, এই রাতে তাঁদের মৃত পূর্বপুরুষদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য প্রার্থনার আয়োজন করা হয়।

সিহাহ সিত্তাহ বা বিশুদ্ধ ছয়টি হাদিসগ্রন্থের কোনো কোনো হাদিসে এই রাতের বিশেষত্ব নির্দেশক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য হাদিস গ্রন্থেও এই রাতের বিশেষত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়। হাদিসগুলোর সনদ বিভিন্ন মানের এবং এবিষয়ে মতভেদ বিদ্যমান। হাদিস শাস্ত্রে 'শবে বরাত' বলতে যে পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়েছে, তা হলো "নিসফ শাবান" বা "লাইলাতুন নিসফি মিন শা'বান" তথা "শা'বান মাসের মধ্য রজনী"। একটি হাদীসে বলা হয়েছে,

রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে আত্নপ্রকাশ করেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত তাঁর সৃষ্টির সকলকে ক্ষমা করেন।

— (ইবনু মাজাহ, আস- সুনান ১/৪৪৫; বাযযার, আল-মুসনাদ ১/১৫৭, ২০৭, ৭/১৮৬; আহমদ ইবনু হাম্বল, আল-মুসনাদ ২/১৭৬; ইবনু আবি আসিম, আস-সুন্নাহ,পৃ ২২৩-২২৪; ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ১২/৪৮১; তাবরানী, আল-মুজাম আল-কাবীর, ২০/১০৮, ২২/২২৩; আল-মুজাম আল-আওসাত, ৭/৬৮; বায়হাক্বী, শু’আবুল ঈমান, ৩/৩৮১; ইবনু খুযায়মা, কিতাবুত তাওহীদ ১/৩২৫-৩২৬।)[সনদ সহীহ][১][২][৩]

বিভিন্ন সহীহ হাদীসে বর্নিত আছে, মুহাম্মাদ (সঃ) এ মাসে বেশি বেশি নফল রোযা পালন করতেন। শাবান মাসের রোযা ছিল তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। এমাসের প্রথম থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত এবং কখনো কখনো প্রায় পুরো শাবান মাসই তিনি নফল সিয়াম পালন করতেন। এ বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,

“এ মাসে রাব্বুল আলামীনের কাছে মানুষের কর্ম উঠানো হয়। আর আমি ভালবাসি যে, আমার রোযা রাখা অবস্থায় আমার আমল উঠানো হোক।”

— (নাসাঈ, আস-সুনান ৪/২০১; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/২৪৭।[সনদ হাসান][১])

হাদিস অনুসারে এই রাত দোয়া কবুল, ক্ষমা প্রার্থনা সহ আল্লাহ'র কাছে চাওয়ার রাত। যথা:

عليه وسلم : إذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا نهارها فإن الله ينـزل فيها لغروب الشمس إلى سماء الدنيا فيقول : ألا من مستغفر فأغفر له ألا من مسترزق فأرزق له ألا من مبتلى فأعافيه ألا كذا ألا كذا حتى يطلع الفجر. (رواه ابن ماجه، والبيهقي في شعب الإيمان. وهذا حديث ضعيف لأن في سنده ابن أبي سبرة وهو معروف بوضع الحديث عند المحدثين. المرجع : تحفة الأحوذي بشرح جامع الترمذي وقال ناصر الدين الألباني في هذا الحديث: إنه واه جداً)

অর্থ : আলী ইবনে আবী তালেব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন তোমরা রাত জেগে সালাত আদায় করবে আর দিবসে সিয়াম পালন করবে। কেননা আল্লাহ তা’আলা সূর্যাস্তের পর দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বলেন : আছে কি কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিয্‌ক প্রার্থনাকারী আমি রিয্‌ক দান করব। আছে কি কোন বিপদে নিপতিত ব্যক্তি আমি তাকে সুস্থ্যতা দান করব। এভাবে ফজর পর্যন্ত বলা হয়ে থাকে। ফুটনোটঃ [উক্ত হাদিসের রাবী (আবু বকর বিন আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ) বিন আবু সাবরাহ সম্পর্কে ইমামগণ বলেন, তিনি দুর্বল। ২. ইবরাহীম বিন মুহাম্মাদ সম্পর্কে ইবনু হিব্বান সিকাহ বললেও অন্যত্রে তিনি বলেন, তিনি হাদিস বর্ণনায় ভুল করেন। ইমাম যাহাবী তাকে সত্যবাদী বলেছেন।

সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৩৮৮ হাদিসের মান: জাল হাদিস

আবূ হুরাইরা (রাঃ) বর্ণিত বুখারী ও মুসলিমের হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা’আলা প্রতি রাতের শেষ অংশে দুনিয়ার আকাশে আসেন। আর প্রতি রাতের মধ্যে শাবান মাসের পনের তারিখের রাতও অন্তর্ভুক্ত। অতএব এ হাদীস মতে অন্যান্য রাতের মত শাবান মাসের পনের তারিখের রাতের শেষ তৃতীয়াংশে আল্লাহ তা’আলা দুনিয়ার আকাশে আসেন

হজরত আয়িশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সেজদা করলেন যে আমার ধারণা হলো, তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন; আমি তখন উঠে তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল; তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়িশা! তোমার কি এ আশঙ্কা হয়েছে? আমি উত্তরে বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)! আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না? নবীজি (সা.) বললেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলই ভালো জানেন। তখন নবীজি (সা.) বললেন, এটা হলো অর্ধশাবানের রাত; এ রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন; ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন, অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন। (শুআবুল ইমান, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৮২)।

হজরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবীজি (সা.) এ রাতে মদিনার কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকি’তে এসে মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার করতেন। তিনি আরও বলেন, নবীজি (সা.) তাঁকে বলেছেন, এ রাতে বনি কালবের ভেড়া বকরির পশমের (সংখ্যার পরিমাণের) চেয়েও বেশিসংখ্যক গুণাহগারকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ৭৩৯)।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন শাবানের মধ্য দিবস আসবে, তখন তোমরা রাতে নফল ইবাদত করবে ও দিনে রোজা পালন করবে। (ইবনে মাজাহ)। ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো নামাজ; সুতরাং নফল ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো নফল নামাজ। প্রতিটি নফল ইবাদতের জন্য তাজা অজু বা নতুন অজু করা মোস্তাহাব। বিশেষ ইবাদতের জন্য গোসল করাও মোস্তাহাব। ইবাদতের জন্য দিন অপেক্ষা রাত শ্রেয়তর। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ১৪ শাবান দিবাগত রাত যখন আসে, তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলায় রোজা রাখো; কেননা, এদিন সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং আহ্বান করেন; কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছ কি? আমি ক্ষমা করব; কোনো রিজিকপ্রার্থী আছ কি? আমি রিজিক দেব; আছ কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি উদ্ধার করব। এভাবে ভোর পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে আহ্বান করতে থাকেন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৩৮৪)।

শবে বরাতের ইতিহাস

হযরত মুহাম্মদ (সা.) হতে শবে বরাতের ব্যাপারে অনেক হাদীস আমাদের হস্তগত হয়েছে। তবে যেসব হাদীসসমূহ পরিপূর্ণতার আলোকে ইসলামের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্যতারাখে তা নিম্নে বর্ণিত হল, যথা:

রাসূলে খোদা (সা.) বলেছেন: শা’বান মাসের মধ্য রজনীতে (১৫ ই শা’বানের রাতে) ঘুমিয়ে ছিলাম এমন সময় জিব্রাঈল(আ.)আমার শিয়রে উপস্থিত হয়ে বলল: হে মুহাম্মদ উঠুন! এরপর সে আমাকে শোয়া থেকে উঠালো এবং বাকী কবরস্থানে নিয়ে গিয়ে বলল: আকাশের দিকে চেয়ে দেখুন! আজ রাতে আসমানের দরজাসমূহ, রহমতের দরজাসমূহ খুলে যাবে এবং খুলে যাবে সকল সুখ, সমৃদ্ধি, ক্ষমা, রুযি, পরিত্রাণ পাওয়া ও পূনর্জ্জিবীত হওয়ার দরজাসমূহ ও আরো অন্যান্য ...।

আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা এ রাতে চতুস্পদ জন্তুর গায়ের চুল ও পশমের পরিমাণ নিজ বান্দাগণকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দান করবেন। এ রাতে তিনি মৃত্যুর সময় এবং আগামী এক বছরের রিযিক (এখানে সকল নেয়ামতকেই বুঝানো হয়েছে) নির্ধারণ করবেন। হে মুহাম্মদ! যারা এ রাতে জাগ্রত থেকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালাকে পবিত্র ও একক সত্তা যেনে তাঁর যিকির করবে, তাকে রাজি-খুশি করার জন্য নামায-দোয়া পড়বে, পবিত্র কোরআন পাঠ করবে ও অধিক পরিমাণে এস্তগফার করে রাতকে প্রভাবে পৌছাবে তাদের স্থান হবে বেহেশ এবং তারা ইতিপূর্বে যা কিছু (গোনাহ) আঞ্জাম দিয়েছে ও পরবর্তিতে আঞ্জাম দিবে তাও ক্ষমা করে দিবেন...।

দ্বিতীয় হিজরীর ১৫ইশা’বানের মধ্য রাতে উক্ত ঘটনাটি সংঘটিত হয়। আর তখন থেকেই শবে বরাতের এ রসম-রেওয়াজ প্রচলিত হয়। (ইবনে তাউউস, আলী বিনমুসা, ইকবালুল আ’মাল, পৃ.- ২১২, বৈরুত প্রিন্ট, প্রকাশক: মুয়াস্সিসাতুল আয়া’লামিলিল মাতবুআ’ত, ১৪১৭ হিজরী। আল্ মাজলিসি, মুহাম্মদ বাকির, বিহরুল আনওয়ার, খণ্ড-৯৮,পৃ.-৪১৩, বৈরুত প্রিন্ট, প্রকাশক: মুয়াস্সিসাতুল ওয়াফা, ১৪০৩ হিজ)

আমরা এটা জানি যে, এ পৃথিবীতে কোন কিছুই কার্যকারণ ব্যতীত সংঘটিত হয় না। তাই ১৫ই শা’বান ফযিলত মণ্ডিত হওয়ার পেছনেও নিহিত রয়েছে উপযুক্ত কার্যকারণ। আর তা হচ্ছে আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়াতা’য়ালার সর্বশেষ হুজ্জাত, নবী(সা.)-এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বংশধারার নবম সন্তান ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর শুভ জন্মরাত।

যিনি শেষ যমানায় আবির্ভূত হয়ে বিশ্বকে সমস্ত প্রকার অন্যায়-অত্যাচার, নীপিড়ন-নির্যাতন ও যালিমের যুলুম থেকে রক্ষা করে ন্যায়ের মানদন্ডের আওতায় নিয়ে আসবেন এবং খোদায়ী শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন। তখন এ পৃথিবীতে থাকবে না কোন প্রকার যুলুম-অত্যাচার, থাকবে না কোন ভেদাভেদ, বাঘ ও ছাগল একই তীরে এক সঙ্গে পানি পান করবে। তখন না বাঘ ছাগলের উপর হামলা করবে আর না ছাগল বাঘকে ভয় পাবে। আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামিন আমাদেরকে সে দিন দেখে যাওয়ার তৌফিক দান করুন।

এ রাত ফযিলত মণ্ডিত হবার প্রকৃত কারণ আমারা জানতে পারলাম। পবিত্র মা’সুমিন(আ.)-গণও এ রাত ফযিলত মণ্ডিত হবার প্রকৃত কারণ এই পবিত্র ব্যক্তিত্বের জন্ম গ্রহণের কারণকেই উল্লেখ করেছেন। সাইয়্যেদ বিন তাউস তিনি স্বীয় গ্রন্থে লিখেছেন: যেহেতু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা এত বড় ও সর্বাধিক উত্তম কল্যান বা অনুগ্রহ দান করেছেন সেহেতু প্রতিটি মানুষের উচিৎ সেই মহান সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তাঁর শুকরিয়া আদায় করা এবং শরীরের সর্বশেষ শক্তি দিয়ে এই সর্বোত্তম এলাহী নেয়া’মতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। (ইবনে তাউউস, আলীবিন মুসা, ইকবালুল আ’মাল, পৃ.-২০৭ থেকে ২৩৭ পর্যন্ত, বৈরুত প্রিন্ট, প্রকাশক:মুয়াস্সিসাতুল আয়া’লামি লিল মাতবুআ’ত, ১৪১৭ হিজরী। আল্ মাজলিসি, মুহাম্মদ বাকির, বিহরুল আনওয়ার, খণ্ড-৯৪, পৃ.-৮৫, হা.-৫, বৈরুত প্রিন্ট, প্রকাশক: মুয়াস্সিসাতুলওয়াফা, ১৪০৩ হিজরী।)

আমরা ১৫ই শা’বানের আমলে লিপিবদ্ধ একটি দোয়ায় পড়ে থাকি যে,

((اللهم بحق ليلتنا هذه و مولودها و حجتك و موعودها التى قرنت الى فضلها فضلا فتمت كلمتك صدقا و عدلا لا مبدل لكلماتك ...))

হে আল্লাহ্! তোমাকে এ রাতের ও এ রাতে জন্মগ্রহণকারীর উছিলা দিয়ে ডাকছি এবং তোমার সত্য ও প্রতিশ্রুত হুজ্জাতের উছিলা ধরছি যে, যার কারণে ফযিলতের উপর ফযিলত দিয়েছো। আর তোমার সত্য ও ন্যায়ের বাণী পরিপূর্ণতায় পৌচেছে এবং তোমার বাণীর পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করার ক্ষমতা করো নেই। (ইবনে তাউউস, আলীবিন মুসা, ইকবালুল আ’মাল, পৃ.-২১৯, বৈরুত প্রিন্ট, প্রকাশক: মুয়াস্সিসাতুল আয়া’লামিলিল মাতবুআ’ত, ১৪১৭ হিজরী।)

ইমাম মাহদী (আ.ফা.)যে ২৫৫ হিজরীর ১৫ই শা’বানে জন্মগ্রহণ করেছেন তার প্রমাণ শিয়া ও সুন্নি মাযহাবের অনেক রেওয়ায়েতেই পাওয়া যায় এবং উক্ত হাদীসসমূহে এ বিষয়টিও পরিস্কারভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, এ রাতে তাঁর জন্মগ্রহণই হচ্ছে এ রাতের ফযিলতের কারণ। (আল্ কুলাইনী, মুহাম্মদ বিন ইয়াকুব, আল্ কাফী, খণ্ড-১, পৃ.-৫১৪, তেহরান প্রিন্ট, প্রকাশক: দারুলকুতুবিল ইসলামিইয়্যা, সন ১৩৬৫ ফার্সি। আছ্ ছাদুক, মুহাম্মদ বিন আলী ইবনুল হুসাইন, কামালু্দ্দিন ওয়া তামামুন্ নেয়া’মাত, খণ্ড-২, পৃ.-৪৩২, তেহরান প্রিন্ট, প্রকাশক:দারুল কুতুবিল ইসলামিইয়্যা, সন ১৩৯৫ ফার্সি। সাবরাবি, আব্দুল্লাহ্ বিন মুহাম্মদ, আল্ ইত্তাহাফু বিহুব্বিল আশরাফ, পৃ.-১৭৯। ইবনে ছাব্বাগুল মালিকি, নুরুদ্দিন আলী বিনমুহাম্মদ, আল্ ফুছুলুল মুহিম্মাতু ফি মায়া’রিফাতিল আইম্মাহ্, পৃ.-৩১০।)

আল কুরআন ও হাদীস পাকের আলোকে পবিত্র শবে বরাত

بِسْمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحْمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ

অর্থঃ শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।

সূরা আদ-দুখান (الدّخان), আয়াতঃ ১।

حمٓ

অর্থঃ হা-মীম।

সূরা আদ-দুখান (الدّخان), আয়াতঃ ২। 

وَٱلْكِتَٰبِ ٱلْمُبِينِ

অর্থঃ শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের।

সূরা আদ-দুখান (الدّخان), আয়াতঃ ৩। 

إِنَّآ أَنزَلْنَٰهُ فِى لَيْلَةٍ مُّبَٰرَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ

অর্থঃ আমি একে নাযিল করেছি। এক বরকতময় রাতে, নিশ্চয় আমি সতর্ককারী।

সূরা আদ-দুখান (الدّخان), আয়াতঃ ৪। 

فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ

অর্থঃ এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়।

তাজেদারে কায়েনাত ইমামুল আম্বিয়া হুজুর রাসূলুল্লাহ (দঃ) এঁর শানে রিসালাত ও পবিত্র আহলে বাঈত পাক (আঃ) আজিম শান পাকে তাজিম প্রকাশ পূর্বক নিবেদন করছি যে,

পবিত্র ইসলাম ধর্মে আরবী ১২ মাসের অষ্টম মাস শাবান। শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত্রটি আল-কুরআনের ভাষায়- ليلة مباركة (লাইলাতুম মুবারাকা) বা বরকতময় রজনী, আর  পবিত্র হাদীস পাকের ভাষায়-ليلة النصف من شعبان (লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান) বা শাবানের মধ্য রজনী।

পবিত্র শবে বারাআত কি বা কেন ?

“শব” শব্দটা ফার্সি। যার অর্থ হল-রাত। আর বরাআত এটি আরবী শব্দ। মূলত হল-براءت যার অর্থ হল “মুক্তি” তথা জাহান্নাম থেকে মুক্তির রাত হল পবিত্র শবে বারাআত। বরাত বলাটা ভুল। কারণ শবে বরাত (برات) মানে হল বিয়ের রাত। সুতরাং আমরা বলব-শবে বারাআত( شب براءت)

পবিত্র শবে বারাআত কে হাদিস পাকের পরিভাষায় বলা হয়েছে “লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান”(ليلة النصف من شعبان) তথা শাবানের অর্ধ মাসের রাত।

কেউ কেউ “পবিত্র শবে বরাআত” নামে হাদিসে শব্দ না থাকায় এ রাতকে অস্বিকার করার মত জেহালাত বা মূর্খতা এবং অজ্ঞতার যুক্তি দিয়ে থাকেন। যাহারা মূর্খতা এবং অজ্ঞতার মধ্যে নিমজ্জিত এবং যাহারা সাম্প্রদায়িক গোড়ামীর মধ্যে আছেন। 

তাহাদের চৈতন্যদান এর উদ্দেশ্যেই বিনীত ভাবে নিবেদন করছি, পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া আবশ্যক বলি আল-কুরআন ও পবিত্র হাদিস পাকে বর্ণিত নির্দেশের কারণে। কিন্তু আল-কুরআন পাকের এবং পবিত্র  হাদিস পাকে কোথাও কি "নামায" শব্দ আছে?

তাওহীদ কে আমরা ঈমানের শর্ত বলি। কিন্তু আল-কুরআন পাকে এবং পবিত্র  হাদীস পাকের কোথাও তাওহীদ শব্দ নেই। তাই বলে কি তাওহীদ আল-কুরআন এবং পবিত্র হাদীস পাক দিয়ে প্রমাণিত নয়? আমরা যাকে নামায বলি সেই অর্থ বোধক কুরআন হাদিস পাকের উদ্ধৃত শব্দ “সালাত”ই হল নামায। আমরা যাকে তাওহীদ বলি কুরআন হাদীস পাকের একত্ববাদ প্রকাশক সকল শব্দই হল এ তওহীদ।

তেমনি আমরা যাকে “শবে বারাত” বলি তথা শাবানের পনের তারিখের রাত বলে থাকি এই অর্থ বোধক শব্দ পবিত্র হাদিস পাকে পাওয়া গেলে তা’ই হবে শবে বারাআত। আর এই অর্থবোধক পবিত্র হাদীস পাকে বর্ণিত শব্দ হল “লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান”। সুতরাং তাই হল শবে বারাত।

পবিত্র আল-কুরআন পাকে শবে বরাত বা নিসফে শাবান :

পবিত্র আল-কুরআন পাকে ও নির্ভরযোগ্য তাফসিরের কিতাবের ভাষ্য-

সূরা দুখানের ১-৪ নং আয়াত পাকে মহান আল্লাহ পাক বলেনঃ

حم-والكتاب المبين- إنا أنزلناه فى ليلة مباركة- إنا كنا منذرين- فيها يفرق كل أمر حكيم-

হা-মীম, এ স্পষ্ট কিতাবের শপথ! নিশ্চয়ই আমি তা বরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছি। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে বন্টন করে দেওয়া হয় প্রত্যেক হিকমতের কাজ।

এ আয়াতের তাফসীর সম্পর্কে বিশ্ব বরেণ্য নির্ভরযোগ্য

মুফাসসিরগণের মতামত নিম্নে প্রদত্ত হইলঃ 

১। তাফসীরে জালালাইন শরীফে ৪১০ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে যে,

ان انزلناه فى ليلة مباركة هى ليلة القدر او ليلة النصف من شعبان نزل فيها من ام الكتاب من السماء السابعة الى السماء الدنيا انا كنا منذرين-

অর্থাৎঃ নিশ্চয়ই আমি তা বরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছি। আর বরকতময় রাত হল লাইলাতুল ক্বদর (ক্বদরের রাত) অথবা লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান (শাবানের মধ্য রাত তথা শবে বরাত)। কেননা এই রাতে উম্মুল কিতাব (কোরআন শরীফ) ৭ম আসমান থেকে দুনিয়ার আসমানে (১ম আসমান) নাযিল হয়েছে। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। 

২। তাফসীরে তাবারী শরীফ পৃষ্ঠা-২২, খন্ড ১০ -এ বর্ণিত আছে যে,

عن محمد بن سوفة, عن عكرمة فى قول الله تبارك وتعالى (فيها يفرق كل أمر حكيم) قال: فى ليلة النصف من شعبان يبرم فيها أمر السنة وتنسخ الأحياء من الأموات ويكتب الحاج فلا يزاد فيهم أحد, ولا ينقص منهم أحد.

كذا أخرج ابن جرير وابن منذر وابن أبى حاتم وكذا فى روح المعانى-

মহান আল্লাহ পাকের বাণী فيها يفرق كل أمر حكيم এর তাফসীরে বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত ইকরামা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মধ্য শাবানের রাত্রিতে বছরের সকল ব্যাপার চূড়ান্ত করা হয়, জীবিত ও মৃতদের তালিকা লেখা হয় এবং হাজীদের তালিকা তৈরি করা হয়। এ তালিকা থেকে একজনও কমবেশি হয় না।

অনুরূপ বর্ণনা করেছেন ইবনুল মুনজির ও ইবনু আবি হাতেম (রাঃ)। এরূপ রেওয়াত ও রুহুল মায়ানীতে আছে।

৩। তাফসীরে কুরতুবী পৃষ্ঠা-১২৬, খন্ড ১৬ এ বর্ণিত আছে যে,

ولها أربعة أسماء: الليلة المباركة, وليلة البراءة, وليلة الصك, وليلة النصف من شعبان-

হযরত ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, এ রাতের ৪ টি নাম আছে-

ক।  লাইলাতুম মুবারাকা,

খ। লাইলাতুল বারাআত 

গ। লাইলাতুছ্ ছাক 

ঘ। লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান।

৪। তাফসীরে বাগভী পৃষ্ঠা-২২৮, খন্ড ৭ -এ বর্ণিত আছে যে,

عن ابن عباس رضى الله عنهما أن الله يقضى الأقضية فى ليلة النصف من شعبان, ويسلمها إلى أربابها فى ليلة القدر- 

অর্থাৎঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল বিষয়ের চূড়ান্ত ফয়সালা করেন শবে বরাতের রাতে এবং তা সংশ্লিষ্ঠ দায়িত্ববান ফেরেস্তাদের কাছে ন্যস্ত করেন শবে ক্বদরের রাতে। 

এ রকম ৬৫ টি তাফসীর গ্রন্থে লাইলাতুম মুবারাকা বলতে শবে ক্বদরের পাশাপাশি মধ্য শাবান অর্থাৎ ১৪ শাবানের রাতের কথা ও গুরুত্ব সহকারে বলা হয়েছে।

উল্লেখযোগ্য কিতাবসমূহের নাম নিম্নে প্রদত্ত হইল। 

(১) তাফসীরে ইবনু আবি হাতেম, খণ্ড-১২, পৃষ্ঠা-২১৪। (২) তাফসীরে রুহুল মায়ানী, খণ্ড-২৫, পৃষ্ঠা-১১০। 

(৩) তাফসীরে বাহরুল মুহীত, খণ্ড-৮, পৃষ্ঠা-২৪। 

(৪) তাফসীরে ফাতহুল কাদীর, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-৫৭০। 

(৫) তাফসীরে যাদুল মাছির, খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা-১২২। 

(৬) তাফসীরে নাসাফী, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৩০২। 

(৭) তাফসীরে নিসাপুরী, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-৪৯০। 

(৮) তাফসীরে কাশ্শাফ, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-২৭২। 

(৯) তাফসীরে নুকুত ওয়াল উয়ূন, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-৪৯০।

(১০) তাফসীরে দুররে মানসূর, খণ্ড-১২, পৃষ্ঠা-৬৯।

(১১) তাফসীরে খাজেন, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-১৪৩। 

(১২) তাফসীরে আল বোরহান, খণ্ড-২৩, পৃষ্ঠা-১১৬। 

(১৩) তাফসীরে রাযী, খণ্ড-১৭, পৃষ্ঠা-১৩৩। 

(১৪) তাফসীরে আলুসী, খণ্ড-১৮, পৃষ্ঠা-৪২৪। 

(১৫) তাফসীরে হাক্কী, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৬। 

(১৬) তাফসীরে কুরতুবী, খণ্ড-১৬, পৃষ্ঠা-১২৭। 

(১৭) তাফসীরে সাভী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৩০২। 

(১৮) তাফসীরে ইবনে কাসীর, খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা-২৪৬। 

(১৯) তাফসীরে জামিউল বায়ান, খণ্ড-২০, পৃষ্ঠা-১৫১। 

(২০) তাফসীরে নুসূকী, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-১২০। 

(২১) তাফসীরে কাদের, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-১৬৬। 

(২২) তাফসীরে মাযহারী, খণ্ড-৮, পৃষ্ঠা-৩৬৮। 

(২৩) তাফসীরে কাসেমী, খণ্ড-৮, পৃষ্ঠা-৩৬৮। 

(২৪).তাফসীরে কোশাইরী, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-১৯০,।

(২৫) তাফসীরে আবু সাউদ, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-১৩০। 

(২৬) তাফসীরে আয়াতুল আহকাম, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-১৬৬। 

(২৭) তাফসীরে রুহুল বয়ান, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৫৯৮। 

(২৮) তাফসীরে কাশেফুল আসরার, খণ্ড-৯, পৃষ্ঠা-৯৪-৯৮।

(২৯) তাফসীরে মাওয়ারদী, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-১০২। 

(৩০) তাফসীরে সিরাজুম মুনির, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৪৫৮। 

তাফসিরে রুহুল বয়ান ৩য় খন্ড ৫৯৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে- আল্লাহ পাক জাল্লা শানুহু উক্ত রুজি রোজগার ও রিজিক বন্টনের আনুষ্ঠানিক দায়িত্বভার হযরত মিকাঈল (আঃ) এর উপর, কার্যসমূহ ও বন্দেগীর দায়িত্ব ভার ১ম আসমানের ফেরেস্তা হযরত ইসরাইল (আঃ) এর উপর, বিপদাপদ ও দুঃখ দুর্দশায় দূরীকরনের দায়িত্বভার হযরত আযরাইল (আঃ) এর উপর অর্পণ করেন।

পবিত্র শবে বরাতের রজনী যে মুসলিম উম্মার জন্য একটি রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও ফজিলত পূর্ণ রজনী এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। সমস্ত মুফাসসিরীন ও মুহাদ্দিসীনে কেরাম এ রাতকে এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন।

পীরানে পীর দাস্তেগীর গওসূল আজম শায়েখ আবু মুহাম্মদ মহিউদ্দিন আব্দুল ক্বাদের জিলানী আল-হাসানী ওয়াল হুসাইনী (আঃ) পাক তদ্বীয় কিতাব “গুনিয়াতুত্ত্বালেবীন” এর ১ম খন্ডে-এ ৬৮৪ পৃষ্টায় উল্লেখ করেন যে,

 قال الله عز وجل حم والكتاب المبين انا انزلناه فى ليلة مباركة قال ابن عباس رضى الله عنهما حم قضى الله ما هو كائن الى يوم القيمة والكتاب المبين يعنى القران- انا انزلناه يعنى القران فى ليلة مباركة هى ليلة النصف من شعبان وهى ليلة البرأة وقال ذالك اكثر المفسرين-

অর্থাৎঃ মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন- হা-মী-ম প্রকাশ্য মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের শপথ- যে কুরআন কে আমি মুবারক (বরকতময়) রাতে নাযিল করেছি। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর তাফসীর প্রসঙ্গে বলেন যে, রোজ কিয়ামত পর্যন্ত যা হওয়ার আছে- তা মহান আল্লাহ পাক ফয়সালা করে দিয়েছেন। শপথ উজ্জল প্রকাশ্য গ্রন্থ তথা আল-কুরআনের যাকে আমি বরকতময় রাতে অর্থাৎ শাবান মাসের মধ্যবর্তী রজনীতে নাযিল করেছি- ঐ ১৫ শাবানের রাতটি হচ্ছে লাইলাতুল বরাআত- এবং অধিকাংশ মোফাসসিরীনে কেরাম এ মত পোষন করেছেন।

পবিত্র হাদীস পাকের আলোকে লাইলাতুল বরাতের দলীলঃ

দলীল নংঃ ১

عن معاذ بن جبل عن النبي صلى الله عليه و سلم قال : ( يطلع الله إلى خلقه في ليلة النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن

অনুবাদঃ হযরত মুয়াজ বিন জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত। দোজাহানের বাদশাহ তাজেদারে কায়েনাত ইমামুল আম্বিয়া হুজুর রাসূলুল্লাহ (দঃ) ইরশাদ করেছেন অর্ধ শাবানের রাতে অর্থাৎ পবিত্র শবে বরাতে।

মহান আল্লাহ পাক তাঁর সমস্ত মাখলুকের প্রতি মনযোগ আরোপ করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ ভাবাপন্ন ব্যক্তি ছাড়া সকলকে ক্ষমা করে দেন।

সূত্রঃ 

১। সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৫৬৬৫।

২। মুসনাদুল বাজ্জার, হাদীস নং-২৭৫৪।

৩। মুসনাদে ইসহাক বিন রাহওয়াই, হাদীস নং-১৭০২।

৪।আল মুজামুল আওসাত, হাদীস নং-৬৭৭৬।

৫। আল মুজামুল কাবীর, হাদীস নং-২১৫।

৬। সুনানে ইবনে মাজা, হাদীস নং-১৩৯০।

৭। মুসনাদুশ শামীন, হাদীস নং-২০৩।

৮। মুসন্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-৩০৪৭৯।

৯। শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং-৬২০৪।

উল্লেখিত পবিত্র হাদীস পাকের সনদ বিষয়ক আলোচনাঃ

১ম হাদীসের সনদ সহীহ, এ জন্য হযরত ইমাম ইবনে হিব্বান একে কিতাবুস সহীহ-এ বর্ণনা করেছেন।

হযরত ইমাম মুনযিরী, ইবনে রজব, কাস্তাল্লানী, যুরকাবী, নুরুদ্দীন হাইসামী (রহঃ) এবং অন্যান্য হাদীস বিশারদ এ হাদীস পাকটিকে আমলযোগ্য সহীহ বলেছেন। 

সূত্রঃ দেখুন! তারগীব তারহীব ২/১১৮, ৩/৪৫৯ লাত্বাইফুল মা‘আরিফ ১৫১-৩, মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ ৮/৬৫, শারহুল সাওয়াহিব-১০/৫৬১।


বর্তমানে আহলে হাদীস ভাইদের প্রসিদ্ধ শাইখ নাসীরুদ্দীন আলবানী সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহাহ ৩/১৩৫-১৩৯-এ এই হাদীসের সমর্থনে আরো আটটি হাদীস উল্লেখ করার পরে লেখেন, ‘এ সব রেওয়ায়েতের মাধ্যমে এ হাদীসটি নিঃসন্দেহে সহীহ প্রমাণিত হয়।’ এরপর শাইখ আলবানী ঐ সব লোকের বক্তব্য খণ্ডন করেন, যারা কোন ধরনের খোঁজ-খবর ছাড়াই বলে দেন যে লাইলাতুল বরা‘আতের ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীস নেই। তদ্রূপ শাইখ আব্দুর রহমান মুবারকপূরী তুহফাতুল আহওয়াজী -২/৫৩-এ লাইলাতুল বারা‘আতের হাদীসকে আমলযোগ্য প্রমাণিত করেন।

দলীল নংঃ ২

عن علي بن أبي طالب قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم ( إذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا نهارها . فإن الله ينزل فيها لغروب الشمس إلى سماء الدنيا . فيقول ألا من مستغفر لي فأغفر له ألا من مسترزق فأرزقه ألا مبتلى فأعافيه ألا كذا ألا كذا حتى يطلع الفجر )

অনুবাদঃ আমিরুল মুমিনিন ইমামুল মুত্তাক্বীনা ওলীয়ে খোদা ওসীয়ে মুস্তাফা হযরত আলী বিন আবু তালীব (আঃ) থেকে বর্ণিত। দোজাহানের বাদশাহ তাজেদারে কায়েনাত ইমামুল আম্বিয়া হুজুর রাসূলুল্লাহ (দঃ) ইরশাদ করেছেন-যখন শাবান মাসের অর্ধেকের রজনী আসে অর্থাৎ পবিত্র শবে বরাত। তখন তোমরা রাতে নামায পড়, আর দিনের বেলা রোযা রাখ। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক এ রাতে সূর্য ডুবার সাথে সাথে পৃথিবীর আসমানে এসে বলেন-কোন গোনাহ ক্ষমা প্রার্থী আছে কি আমার কাছে? আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। কোন রিজিক প্রার্থী আছে কি? আমি তাকে রিজিক দিব। কোন বিপদগ্রস্থ মুক্তি পেতে চায় কি? আমি তাকে বিপদমুক্ত করে দিব। আছে কি এমন, আছে কি তেমন? এমন বলতে থাকেন ফযর পর্যন্ত।

সূত্রঃ

১। সূনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১৩৮৮।

২। শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং-৩৮২২।

উল্লেখিত হাদীস পাকের  সনদ বিষয়ক আলোচনাঃ

হাদীস পাকের সনদ যয়ীফ কিন্তু মুহাদ্দিসীনে কিরামের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো- ফাযায়েলের ক্ষেত্রে যয়ীফ হাদীস গ্রহণযোগ্য। দেখুন! 

সূত্রঃ কিতাবুল আযকার-৭, ফাতহুল কাদীর-১/৪৬৭, আল আজবিবাতুল ফাযেলাহ-৫৭।

 عن عائشة : قالت فقدت رسول الله صلى الله عليه و سلم ليلة فخرجت فإذا هو بالبقيع فقال أكنت تخافين أن يحيف الله عليك ورسوله ؟ قلت يا رسول الله إني ظننت أنك أتيت بعض نساءك فقال إن الله عز و جل ينزل ليلة النصف من شعبان إلى السماء الدنيا فيفغر لأكثر من عدد شعر غنم كلب

অনুবাদঃ উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়শা (রাঃ) বলেন-এক রাতে দোজাহানের বাদশাহ তাজেদারে কায়েনাত ইমামুল আম্বিয়া হুজুর রাসূলুল্লাহ (দঃ) কে না পেয়ে খুজতে বের হলাম। খুঁজতে খুঁজতে জান্নাতুল বাকীতে (মদীনা শরীফের কবরস্থান) গিয়ে আমি হুজুর পাক (দঃ) কে দেখতে পেলাম। হুজুর পাক (দঃ) বললেন-কি ব্যাপার আয়শা? (তুমি যে তালাশে বের হলে?) তোমার কি মনে হয় মহান আল্লাহ পাক  এবং তাঁর রাসূল (দঃ) তোমার উপর কোন অবিচার করবেন? (তোমার পাওনা রাতে অন্য কোন বিবির ঘরে গিয়ে রাত্রি যাপন করবেন?)

হযরত আয়শা (রাঃ) বললেন- আমার ধারণা হয়েছিল আপনি অন্য কোন বিবির ঘরে গিয়েছেন। হুজুর পাক (দঃ) তখন বললেন যখন শাবান মাসের ১৫-ই রাত আসে অর্থাৎ যখন শবে বরাত হয়, তখন মহান আল্লাহ পাক এ রাতে প্রথম আসমানে নেমে আসেন। তারপর বনু কালব গোত্রের বকরীর পশমের চেয়ে বেশী সংখ্যক বান্দাদেরকে ক্ষমা করে দেন।

সূত্রঃ ১। সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-৭৩৯।

২। মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২৬০২৮।

৩। মুসনাদে আব্দ বিন হুমাইদ, হাদীস নং-১৫০৯।

উল্লেখিত হাদীস পাকের সনদ বিষয়ক আলোচনাঃ

হাদীস পাকটি আমলের ক্ষেত্রে গ্রহণ যোগ্য। সকল রাবী সিক্কাত, সনদের মধ্যে ইনক্বিতা থাকায় ইমাম বুখারী (রহঃ) যয়ীফ বলেছেন। 

সূত্রঃ সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহাহ-৩/৩১৮।

দলীল নংঃ ০৩

 ﻋﻦ ﺍﺑﻰ ﻣﻮﺳﻰ ﺍﻻﺷﻌﺎﺭﻯ ﻋﻦ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ

ﻗﺎﻝ ﺍﻥ ﺍﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﻟﻴﻄﻠﻊ ﻓﻰ ﻟﻴﻠﺔ ﺍﻟﻨﺼﻒ ﻣﻦ ﺷﻌﺒﺎﻥ ﻓﻴﻐﻔﺮ ﻟﺠﻤﻴﻊ

ﺧﻠﻘﻪ ﺍﻻ ﻟﻤﺸﺮﻙ ﺍﻭ ﻣﺸﺎﺣﻦ ) ﺭﻭﺍﻩ ﺍﺑﻦ ﻣﺎﺟﻪ )

অনুবাদঃ হযরত আবূ মূসা আশয়ারী (রাঃ) দোজাহানের বাদশাহ তাজেদারে কায়েনাত ইমামুল আম্বিয়া হুজুর রাসূলুল্লাহ (দঃ) হতে বর্ণনা করেন। হুজুর পাক (দঃ) ইরশাদ ফরমান যে, মধ্য শাবানের রাত্রিতে মহান  আল্লাহ পাক রহমতের তাজাল্লী বষর্ণ করেন এবং তার সমস্ত বান্দাদের কে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু মুশরিক বা শত্রুতাপোষণকারী ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন না।

সূত্রঃ ১। ইবনে মাজাহ শরীফ, পৃষ্ঠা-১০০, হাদীস নং-১৩৮৯।

২। মিশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা-১১৫। 

৩। ইমাম বায়হাকী,শুয়াবুল ঈমান, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা- ৩৮২। 

৪। ফাজায়েলুল আওকাত, পৃষ্ঠা-১৩৩, হাদীস নং-২৯। 

৫। মিসবাহুজ জুজাযাহ, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৪৪২, হাদীস নং-৪৮৭।

৬। আত তারগীব ওয়াত তারহীব, খণ্ড-৩য়, হাদীস নং-২৭১৮।

৭। আহলে হাদীস তথা লা- মাযহাবীদের নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি নাসির উদ্দীন আলবানীর “সিলসিলাতুল আহাদিছে ছহিহা” এর খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-১৩১ আরো ৫ টি হাদীস রয়েছে।

দলীল নংঃ ০৪

সিহাহ্ সিত্তার অন্যতম হাদীসগ্রন্থ ইবনে মাজাহ শরীফের ১০০ পৃষ্ঠায় এবং মিশকাত শরীফের ১১৫ পৃষ্ঠায় আমীরুল মু'মিনিন ইমামুল মুত্তাকীন ওলীয়ে খোদা ওসীয়ে মুস্তাফা ইমামে হক হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (আঃ) হতে মারফু মুত্তাছিল সনদে রেওয়ায়েত করেন- যে, দোজাহানের বাদশাহ তাজেদারে কায়েনাত ইমামুল আম্বিয়া হুজুর রাসূলুল্লাহ (দঃ) ইরশাদ ফরমান যে,

 اذا كانت ليلة النصف من شعبان- فقوموا ليلها وصوموا يومها فان الله تعالى ينزل فيها لغروب الشمس الى السماء الدنيا- فيقول الا من مستغفرلى فاغفرله الا مسترزق فارزقه الا مبتلى فاعافيه الا كذا كذا حتى يطلع الفجر-

অনুবাদঃ যখন শাবানের ১৫ তারিখের রাত্র আগমন করে তখন তোমরা রাত্র জাগরণ করতঃ মহান আল্লাহ পাকের ইবাদত বন্দেগী কর এবং এর পূর্ববর্তী দিনে (১৫ তারিখে) রোজা পালন কর। কেননা চৌদ্দ তারিখের সূর্য অস্থ যাওয়া তথা ১৫ তারিখের রাত্র আরম্ভ হওয়ায় সাথে সাথে মহান আল্লাহ পাক দুনিয়ার আসমানে স্বীয় তাজাল্লী প্রকাশ ফরমান। অর্থাৎ দুনিয়া বাসীর প্রতি বিশেষ রহমতের দৃষ্টি দান করতঃ দয়াপূর্ণ কুদরতী আওয়াজে আহ্বান করে থাকেন। আমার বান্দাদের মধ্যে কেউ আজকের এ পবিত্র রাত্রে আমি আল্লাহর দরবারে নিজের কৃত পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছ কি? আমি তোমাদের ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছি। রুজি-রিজিক চাওয়ার আছ কি? আমি তোমাদের চাহিদা অনুপাতে রিজিক দানের ফয়সালা করে দিব। কোন বিপদগ্রস্থ লোক বিপদ মুক্তির জন্য প্রার্থনাকারী আছ কি? আমি তোমাদের বিপদ দূরীভূত করে দিব। এমন আরো বিষয়ে কেউ প্রার্থনাকারী আছ কি? আমি তা সবই তোমাদেরকে দান করব।

মহান আল্লাহ পাক এরূপ করুনাপূর্ণ ঘোষনা সুবহে সাদিক পর্যন্ত চলতে থাকে।

এছাড়াও হাদীসটি যেসব গ্রন্থে বর্ণিত আছেঃ 

সূত্রঃ 

১। শুয়াবুল ঈমান” ৩য় খন্ড পৃষ্ঠা -৩৭৯ হাদীস নং-৩৮২২।

২। মিসবাহুয যুযায” ১ম খন্ড পৃষ্ঠা,-৪৪ হদীস নং-৪৮৬।

৩। মুসনাদে আহমদ” ৬ষ্ঠ খন্ড, ২৩৮ পৃষ্ঠা।

পবিত্র শবে বরাতের রজনীতে বিশেষ বা নফল আমলঃ 

মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত মহিমান্বিত রাত পবিত্র শবে বরাত। ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে ভবিষ্যতে পরিশুদ্ধ জীবন যাপনের জন্য আল্লাহ পাকের অনুগ্রহ লাভ করার সুযোগ ঘটে এই পবিত্র রাতে। বছর ঘুরে এই পবিত্র রাত আসে সৌভাগ্যের বার্তা নিয়ে।

পবিত্র ইসলাম ধর্মে এই রাত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাত। পবিত্র এই রাতে একনিষ্ঠ ভাবে মহান আল্লাহ পাকের ইবাদত বন্দেগী করলে, আল্লাহ পাকের কাছে নিজের পাপ-গুনাহ ও অন্যায়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি তা কবুল করেন এবং অনুতপ্ত বান্দাকে গুনাহ থেকে মুক্তি দিয়ে তাকে মাফ করে দেন। ইনশাআল্লাহ। 

তাজেদারে কায়েনাত ইমামুল আম্বিয়া হুজুর রাসূলুল্লাহ (দঃ) এই পবিত্র রাতে নফল ইবাদত-বন্দেগিতে নিমগ্ন থাকতে মুসলমানদের নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। শবে বরাত সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘জিবরাইল (আঃ) আমাকে বলেছেন, আপনি আপনার উম্মতদের জানিয়ে দিন, তারা যেন পবিত্র শবে বরাতের রাতকে জীবিত রাখে।’ অর্থাৎ তারা যেন ইবাদতের মধ্য দিয়ে রাতটি কাটিয়ে দেয়।

মহিমান্বিত এই রজনীতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা বিগত জীবনের সব ভুল-ভ্রান্তি, পাপ-তাপের জন্য গভীর অনুশোচনায় মহান আল্লাহ পাকের দরবার পাকে নিজেদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

নফল নামাজ, জিকির-আজকার, পবিত্র আল-কুরআন মজিদ তিলাওয়াতের মধ্য দিয়ে বিনিদ্র রাত কাটিয়ে বিনম্র প্রার্থনা করেন ভবিষ্যৎ জীবনে পাপ-পঙ্কিলতা পরিহার করে পরিশুদ্ধ জীবন যাপনের জন্য।

একইসঙ্গে নিজ পিতা-মাতার জন্য, মরহুম আত্মীয়-স্বজনসহ চিরবিদায় নেয়া মুসলিম নর-নারীর কবর জিয়ারত করে তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করেন। এ ছাড়া পাড়া-মহল্লার মসজিদ পাক গুলোতেও সন্ধ্যার পর থেকেই মিলাদ মাহফিল ও বিশেষ দোয়া ও মোনাজাতের আয়োজন করা হয়।

অনেকে গভীর রাত পর্যন্ত ইবাদত-বন্দেগিতে মগ্ন থেকে শেষ রাতে সেহরি খেয়ে পরদিন নফল রোজা রাখেন। যাহার যেমন শারীরিক সক্ষমতা আছে তিনি সেভাবে ইবাদত-বন্দেগিতে নিমগ্ন থাকবেন। 

শাবান মাসের পরই আসে পবিত্র মাহে রমজান। তাই শবে বরাত মুসলমানদের কাছে রমজানের আগমনী বার্তা বয়ে আনে। শবে বরাতের মধ্য দিয়েই শুরু হয় রমজান মাসের সিয়াম সাধনার প্রস্তুতি।

পবিত্র শবে বরাতের নামাজের নিয়ত আরবীতেঃ 

“নাওয়াইতুআন্ উছল্লিয়া লিল্লাহি তা'য়ালা রাক‘আতাই ছালাতিল লাইলাতিল বারাতি নাফলি মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল্ কা'বাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবার”।

বাংলায় নিয়তঃ- “ আমি ক্বেবলামুখী হয়ে মহান আল্লাহ  পাকের উদ্দেশ্যে শবে বরাতের দুই 'রাক'আত নফল নামাজ আদায়ের নিয়ত করলাম- আল্লাহু আকবার”।

শবে বরাতের নামাজঃ 

শবে বরাতের নামাজ দু'রাকাত করে যত বেশি পড়া যায় তত বেশি ছওয়াব। নামাজের প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহা পড়ার পর সূরা ইখলাছ, সূরা ক্বদর, আয়াতুল কুরছী বা সূরা তাকাছুর ইত্যাদি মিলিয়ে পড়া অধিক ফজিলাতের ও ছওয়াবের কাজ। এভাবে কমপক্ষে ১২ রাকাত নামাজ আদায় করা উত্তম। এর বেশি যত রাকাত আদায় করা যায় ততই উত্তম।

প্রতি ৪ রাকাত পর পর কিছু কালামে পাক তেলাওয়াত ও তাসবিহ্-তাহলীল আদায় করে মহান আল্লাহ পাকের দরবার পাকে করুণ ভাবে ফরিয়াদ করে দোয়া কামনা করা অতি উত্তম। এভাবে সারা রাত নামাজ আদায় করা যেতে পারে। যাহার যত টুকু শারীরিক ক্ষমতা আছে। 

পবিত্র শবে বরাতে এভাবে নামাজ আদায় করে মহান আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভ করা যেতে পারে। তাই আসুন এই পবিত্র রাতে আমরা বেশি বেশি করে নফল নামাজ আদায় করি।

দোজাহানের বাদশাহ তাজেদারে কায়েনাত ইমামুল আম্বিয়া হুজুর রাসূলুল্লাহ (দঃ) ইরশাদ করলেন,

هذه ليلة النصف من شعبان ان الله عزو جل يطلع على

عباده فى ليلة النصف من شعبان فيغفر للمستغفرين

ويرحم المشترحمين ويؤخر اهل الحقد كماهم

‘এটা হল অর্ধ শাবানের রাত (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত)। মহান আল্লাহ পাক অর্ধ-শাবানের রাতে তার বান্দার প্রতি মনযোগ দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ দান করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।‘ 

সূত্রঃ শুআবুল ঈমান, বাইহাকী ৩/৩৮২-৩৬৮।

হযরত ইমাম বাইহাকী (রহঃ) এই হাদীস পাকটি বর্ণনার পর এর সনদের ব্যাপারে বলেছেন,

هذا مرسل جيد

এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়, এ রাতে দীর্ঘ নফল পড়া, যাতে সেজদা ও দীর্ঘ হবে, শরীয়তের দৃষ্টিতে কাম্য। তবে মনে রাখতে হবে যে, অনেক অনির্ভরযোগ্য ওয়ীফার বই-পুস্তকে নামাযের যে নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন লেখা আছে অর্থাৎ এত রাকআত হতে হবে, প্রতি রাকআতে এই সূরা এতবার পড়তে হবে – এগুলো ঠিক নয়।

সঠিক পদ্ধতি হল, নফল নামাযের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী দুই রাকআত করে যত রাকআত সম্ভব হয় পড়তে থাকা। আল-কুরআন পাক তেলওয়াত করা। দোয়া দরূদ শরীফ পড়া। ইস্‌তেগফার করা। দোয়া করা এবং কিছুটা ঘুমের প্রয়োজন হলে ঘুমানো। এমন যেন না হয় যে, সারা রাতের দীর্ঘ ইবাদতের ক্লান্তিতে ফজরের নামায জামাআতের সাথে পড়া সম্ভব হল না।

পবিত্র শবে বরাতের পরদিন রোযা রাখার বিধানঃ 

সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছেঃ 

 عن على بن ابى طالب رضى الله عنه قال : قال رسول الله (() : إذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا نهارها, فإن الله ينزل فيهالغروب الشمس الى سماء الدنيا, فيقول : ألا من مستغفر فاغفر له على مستزرق فأرزقه, ألا مبتلى فأعافيه , ألا كذا, ألا كذا, حتى يطلع الفجر

মওলায়ে কায়েনাত ওলীয়ে খোদা ওসীয়ে মুস্তাফা ইমামে হক হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (আঃ) থেকে বর্ণিত, 

দোজাহানের বাদশাহ তাজেদারে কায়েনাত ইমামুল আম্বিয়া হুজুর রাসূলুল্লাহ (দঃ) বলেছেন, ১৫ ই শাবানের রাত (চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগীতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোযা রাখ। কেননা, এ রাতে সূর্যাস্তের পর মহান আল্লাহ পাক প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, কোন ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিযিক প্রার্থী? আমি তাকে রিযিক দেব। এভাবে সুব্‌হে সাদিক পর্যন্ত মহান আল্লাহ পাক মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে তাদের ডাকতে থাকেন।

সূত্রঃ সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৩৮৪ শু’আবুল ঈমান-৩৮২৩-২২। 

তাছাড়া শাবান মাসে বেশি বেশি নফল রোযা রাখার কথা সহীহ হাদীসে এসেছে এবং আইয়ামে বীয অর্থাৎ প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখার বিষয়টি ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

১৫  ই শাবানের দিনটি শাবান মাসেরই একটি দিন এবং তা আয়্যামে বীযের অন্তর্ভূক্ত। এজন্য ফিক্‌হের একাধিক কিতাবেই এদিনে রোযাকে মুস্তাহাব বা মাসনূন লেখা হয়েছে। আবার অনেকে বিশেষ ভাবে এ দিনের রোযাকে মুস্তাহাব বা মাসনুন বলতে অস্বীকার করেছেন। এ প্রসঙ্গে হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ত্বাকী উসমানী (দাঃবাঃ) তার ইসলাহী খুতুবাতে বলেন, ‘আরো একটি বিষয় হচ্ছে পবিত্র শবে বরাতের পরবর্তী দিনে অর্থাৎ শাবানের ১৫ ই তারিখে রোযা রাখা। গভীর ভাবে বিষয়টি উপলব্ধি করা প্রয়োজন। হাদীসে রাসুলের বিশাল ভান্ডার হতে একটি মাত্র হাদীস এর সমর্থনে পাওয়া যায়। তাতে বলা হয়েছে, পবিত্র শবে বরাতের পরবর্তী দিনটিতে রোযা রাখ।‘ সনদ বর্ণনার সূত্রের দিক থেকে হাদীসটি দুর্বল। তাই এ দিনের রোযাকে এই একটি মাত্র দুর্বল হাদীসের দিকে তাকিয়ে সুন্নাত বা মুস্তাহাব বলে দেওয়া অনেক আলেমের দৃষ্টিতে অনুচিত।’

তবে হ্যাঁ, শাবানের গোটা মাসে রোযা রাখার কথা বহু হাদীসে পাওয়া যায়। অর্থাৎ ১ শাবান থেকে ২৭ শাবান পর্যন্ত রোযা রাখার যথেষ্ট ফযীলত রয়েছে। কিন্তু ২৮ ও ২৯ তারিখে রোযা রাখতে দোজাহানের বাদশাহ তাজেদারে কায়েনাত ইমামুল আম্বিয়া হুজুর রাসূলুল্লাহ (দঃ) নিজেই বারণ করেছেন। ইরশাদ করেন, রমযানের দু-একদিন পূর্বে রোযা রেখো না। যাতে রমযানের পূর্ণ স্বস্তির সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রস্তুতি নেওয়া যায়। কিন্তু ২৭ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিনের রোযাই অত্যন্ত বরকতপূর্ণ।

একটি লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হচ্ছে যে, শাবানের এই ১৫ তারিখটি তো ‘আইয়ামে বীয’ এর অন্তর্ভূক্ত। আর হুজুর পাক (দঃ) প্রতি মাসের আইয়ামে বীয এ রোযা রাখতেন। সুতরাং যদি কোন ব্যক্তি এই দুটি কারণ কে সামনে রেখে শাবানের ১৫ তারিখের দিনে রোযা রাখে যা আইয়ামে বীয এর অন্তর্ভূক্ত, পাশাপাশি শাবানের ও একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন, তবে ইনশাআল্লাহ নিশ্চয়ই সে প্রতিদান লাভ করবে। তবে শুধুমাত্র ১৫ শাবানের কারণে এ রোযাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে সুন্নাত বলে দেওয়া অনেক আলেমের মতেই সঠিক নয়। আর সে কারণেই অধিকাংশ ফুকাহায়ে কেরাম মুস্তাহাব রোযার তালিকায় মুহাররমের ১০ তারিখ ও আইয়ামে আরাফা (যিলহজ্জের ৯ তারিখ) এর কথা উল্লেখ করেছেন অথচ শাবানের ১৫ তারিখের কথা পৃথক ভাবে কেউই উল্লেখ করেন নি। বরং তারা বলেছেন, শাবানের যে কোন দিনই রোযা রাখা উত্তম। সুতরাং এ সকল বিষয়ের দিকে দৃষ্টি রেখে যদি কেউ রোযা রাখে তবে ইনশাআল্লাহ সে সওয়াব পাবে।

আহলে সুন্নাতের ফিকাহবিদগণের দৃষ্টিতে লাইলাতুল বারা‘আতঃ 

হানাফী মাজহাব ফিক্বহে হানাফীঃ

আল্লামা শামী, ইবনে নুজাইম, আল্লামা শরমবুলালী, শাইখ আব্দুল হক দেহলভী, হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী, মাওলানা আব্দুল হাই লাক্ষনৌভী, মুফতী মুহাম্মদ শফী সাহেব রহ. সহ প্রমুখ উলামায়ে কেরামের মতে লাইলাতুল বারা‘আতে শক্তি সামর্থ্য অনুযায়ী জাগ্রত থেকে একাকীভাবে ইবাদত করা মুস্তাহাব, তবে জমায়েত হয়ে নয়। 

সূত্রঃ আদ দুররুল মুখতার-২/২৪-২৫, আল বাহরুর রায়িক-২/৫২, মা ছাবাতা বিসসুন্নাহ-৩৬, মারাক্কিল ফালাহ-২১৯, জাওয়ালুস সিনাহ-১৭, লাইলাতুল বরা‘আতের হাক্বীক্বত- শাইখুল ইসলাম মুফতী মুহাম্মদ তাক্বী উসমানী।

শাফেয়ী মাজহাব ফিক্বহে শাফেয়ীঃ

হযরত ইমাম শাফী (রহঃ)এর মতেও শা‘বানের ১৫ তম রাতে অধিক অধিক দু‘আ কবূল হয়ে থাকে।  

সূত্রঃ কিতাবুল উম্ম-১/২৩১।

হাম্বালী মাজহাব ফিক্বহে হাম্বলীঃ

শাইখ ইবনে মুফলিহ হাম্বলী, আল্লামা মানসূর আল বাহুতী এবং ইবনে রজব হাম্বলী (রহঃ) সহ প্রমূখ উলামায়ে কিরামের নিকট লাইলাতুল বারা‘আতে ইবাদাত করা মুস্তাহাব। 

সূত্রঃ দেখুন! আল মাবদা-২/২৭, কাশশাফুল কিনা-১/৪৪৫, লাত্বায়িফুল মা‘আরিফ-১৫১-৬০।

মালিকী মাজহাব ফিক্বহে মালিকীঃ

ইবনুল হাজ্জ্ব মালিকী (রহঃ) বলেন সলফে সালিহীন তথা পূর্বযুগের আউলিয়াগণ এ রাতকে যথেষ্ট সম্মান করতেন এবং এর জন্য পূর্ব থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। 

সূত্রঃ আল মাদখাল-১/২৯২-৯৩।

সারকথাঃ আহলে সুন্নাতের সকল মাযহাবের উলামায়ে কিরামের মতে পবিত্র শবে বরাত/লাইলাতুল বারা‘আতে ইবাদাত করা মুস্তাহাব।

আহলুল হাদীস ভাইদের প্রতি আবেদন

লাইলাতুল বারা‘আত সম্পর্কে কোন আপত্তি থাকলে আপনারা শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ এর ইক্বতিযাউস সিরাতুল মুস্তাক্বীম-২/৬৩১-৬৪৩, আলবানী এর সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহাহ-৩/১৩৫-১৩৯, ইমাম মুবারকপুরীর তুহফাতুল আহওয়াজী-২/৫৩ এবং ইবনে রজব হাম্বলীর লাত্বায়িফুল মা‘আরিফ ১৫১-১৬০ ইত্যাদি প্রমুখ উলামাদের কিতাব দেখুন।

এ রাতের নফল আমলসমূহ সম্মিলিত নয়, ব্যক্তিগত/একাকী ভাবেঃ 

এ বিষয়টিও মনে রাখতে হবে যে, এ রাতের নফল আমলসমূহ, বিশুদ্ধ মতানুসারে একাকী ভাবে করণীয়। ফরয নামাযতো অবশ্যই মসজিদে আদায় করতে হবে। এরপর যা কিছু নফল পড়ার তা নিজ নিজ ঘরে/ইবাদত খানাতে একাকী পড়বে। এসব নফল আমলের জন্য দলে দলে মসজিদে এসে সমবেত হওয়ার কোন প্রমাণ হাদীস শরীফেও নেই আর সাহাবায়ে কেরামরে যুগেও এর রেওয়াজ ছিল না। 

সূত্রঃ ইক্‌তিযাউস সিরাতিল মুসতাকীম ২/৬৩১-৬৪১; মারাকিল ফালাহ ২১৯।

অবে কোন আহবান ও ঘোষণা ছাড়া এমনিই কিছু লোক যদি মসজিদে এসে যায়, তাহলে প্রত্যেকে নিজ নিজ আমলে মশগুল থাকবে, একে অন্যের আমলের ব্যাঘাত সৃষ্টির কারণ হবে না।

পবিত্র শবে বরাতের হালুয়া-রুটিঃ 

পবিত্র শবে বরাতের রাতে পবিত্র খাবার হালুয়া-রুটি ও অন্যান্য উন্নত খাবার তৈরী করা শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ। কারণ ইহা এক ধরণের উন্নত হালাল খাবার। আর দোজাহানের বাদশাহ তাজেদারে কায়েনাত ইমামুল আম্বিয়া হুজুর রাসূলুল্লাহ (দঃ) মিষ্টি অধিক ভালবাসতেন। 

সূত্রঃ বুখারী শরীফ ২য় খন্ড ৮১৭ পৃষ্ঠা সহ আরো বিভিন্ন পৃষ্ঠায় ১১টি হাদীস রয়েছে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, মিশকাত শরীফ ৩৬৪পৃষ্ঠা। 

এছাড়া তিরমিযী শরীফে উল্লেখ আছে দোজাহানের বাদশাহ তাজেদারে কায়েনাত ইমামুল আম্বিয়া হুজুর রাসূলুল্লাহ (দঃ) ইরশাদ করেছেন “হে লোক সকল, তোমরা সালামের প্রচলন কর, মানুষকে অন্য/খাবার দাও, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করো এবং লোকজন যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন নামাজে দন্ডায়মান হও, তবেই তো শান্তিতে বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে। 

এতে বুঝা গেল যে, মেহমানদারী করা খাওয়ানো ও বেহেস্ত লাভের একটি মাধ্যম/উছিলা। পবিত্র শবে বরাতে উপরোক্ত হাদীসের উপর আমল করার সুযোগ হয়।

প্রথমতঃ মুসলমানগণ নামাজে যাবে একে অপরের সাথে সাক্ষাত হবে এবং একে অপরের সাথে সালাম আদান-প্রদান করবে। আর 

দোজাহানের বাদশাহ তাজেদারে কায়েনাত ইমামুল আম্বিয়া হুজুর রাসূলুল্লাহ (দঃ) বলেছেন সালাম আদান-প্রদান একটি উত্তম আমল।

দ্বিতীয়তঃ পবিত্র শবে বরাতে ভাল খাবার বন্টনের মাধ্যমে মানুষকে খাবার খাওয়ানো হলো। পাশাপাশি গরিব-মিসকিনরা একদিন ভাল খাবার খাওয়ার সুযোগ পেল।

তৃতীয়তঃ আত্বীয়-স্বজন একে-অপরের বাসা/বাড়িতে খাবার বিতরণের মাধ্যমে তাদের সম্পর্ক আরো মজবুত হবে। 

(**) তথ্য সুত্র : জাতীয় প‌ত্রিকায় লি‌খিত বি‌ভিন্ন আলেম,মুফ‌তি ও মওলানাদের কলাম থে‌কে ও বি‌ভিন্ন ইসলা‌মিক পুস্তক থে‌কে সংগ্র‌হিত।

- জা‌হিদ আহ‌মেদ ও তার স্মৃ‌তি প‌রিষদ।

শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২০

ঈদে মিলাদুন্ন‌বি পাল‌নের যেী‌ক্তিক দ‌লিল ও ইতিহাস এবং প্রাস‌ঙ্গিকতা -



 

ঈদে  মিলাদুন্ন‌বি  পাল‌নের যেী‌ক্তিক দ‌লিল  ও ইতিহাস এবং প্রাস‌ঙ্গিকতা -

ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী (আরবি: مَوْلِدُ النَبِيِّ‎‎ মাওলিদু এন-নাবীয়ী, আরবি: مولد النبي মাওলিদ আন-নাবী, কখনো কখনো সহজভাবে বলা হয় مولد মাওলিদ, মেভলিদ, মেভলিট, মুলুদ আরো অসংখ্য উচ্চারণ; কখনো কখনো: ميلاد মিলাদ) হচ্ছে শেষ নবীর জন্মদিন হিসেবে মুসলমানদের মাঝে পালিত একটি উৎসব। মুসলিমদের মাঝে এ দিনটি বেশ উৎসবের সাথে পালন হতে দেখা যায়। তবে উৎসব নিয়ে ইসলামি পণ্ডিতদের মাঝে অনেক বিতর্ক রয়েছে। হিজরি বর্ষের তৃতীয় মাস রবিউল আউয়াল-এর বারো তারিখে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।[১] বাংলাদেশি মুসলমানরা এই দিনকে ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী বলে অভিহিত করেন। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের কাছে এই দিন নবী দিবস নামে পরিচিত।

ইতিহাস

হিজরী ৪র্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে মিলাদুন্নবীর প্রচলন শুরু হয়। রাসূল, আলী, ফাতেমা, হাসান ও হুসাইন এর জন্মদিন, এসবের মূল প্রর্বতক ছিল খলীফা আল মুয়িজ্জু লি-দীনিল্লাহ।

এখানে উল্লেখ্য যে, মিশরের এইসব অনুষ্ঠানাদি তখনো মুসলিম বিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েনি।  পরবর্তীতে যিনি ঈদে মিলাদুন্নবীকে মুসলিমবিশ্বের অন্যতম উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, তিনি হলেন, ইরাক অঞ্চলের ইরবিল প্রদেশের  আবু সাঈদ কুকবুরী । সে হিসেবে জানা যায়, ৭ম হিজরী থেকে আনুষ্ঠানিক মিলাদ উদযাপন শুরু হয়। মিলাদের উপর সর্বপ্রথম গ্রন্থ রচনা করে আবুল খাত্তাব ওমর ইবনে হাসান ইবনে দেহিয়া আল কালবী ।

পবিত্র ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি?

ঈদ শব্দের আভিধানিক অর্থ হল খুশী হওয়া, ফিরে আসা, আনন্দ উৎযাপন করা ইত্যাদি। আর মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতে আমরা নবীজীর আগমনকে বুঝায়। আর ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতে নবীজীর আগমনে খুশী উৎযাপন করাকে বুঝায়। সুতরাং অশান্তি আর বর্বরতায় ভরপুর সংঘাতময় আরবের বুকে আধারের বুক চিড়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শান্তি নিয়ে এসে মানবজাতিকে সত্যের, সভ্যতা ও ন্যায়ের দিক নির্দেশনা দিয়ে গোটা বিশ্বকে শান্তিতে পরিপূর্ণ করে তুলেন। নবীজীর পবিত্র শুভাগমনে খুশী উৎযাপন করাটাই হচ্ছে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

কুরআনুল কারীমের দৃষ্টিতে পবিত্র ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম :

আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন বলেন-

অর্থাৎ- আল্লাহ বলেন, হে প্রিয় রাসূল! আপনি স্মরণ করুন ঐ দিনের ঘটনা”- (রোজে আজলের সময়ের) যখন আমি (আল্লাহ) আম্বিয়ায়ে কেরামগণের নিকট থেকে এইভাবে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে, যখন ‘আমি তোমাদেরকে কিতাব এবং হিকমত’ অর্থাৎ নবুয়ত দান করবো, অতঃপর তোমাদের কাছে এক মহান রাসূলের শুভাগমন হবে- যিনি তোমাদের প্রত্যেকের নবুয়তের সত্যায়ন করবেন, তখন তোমরা সকলে অবশ্যই তাঁর উপর ঈমান আনযন করবে এবং সর্বোত্তমভাবে তাঁকে সাহায্য সহযোগিতা করবে। তোমরা কি এ কথার অঙ্গীকার করছো এবং অঙ্গীকারে কি অটল থাকবে? সমস্ত নবীগণ বললেন- হাঁ, আমরা অঙ্গীকার করলাম। আল্লাহ তায়ালা বললেন- তোমরা পরস্পর স্বাক্ষী থেকো এবং আমি ও তোমাদের সাথে স্বাক্ষী রইলাম। এর পরেও যে কেউ পিছপা হয়ে যাবে- তারা হবে ফাসেক।

(*)সূত্রঃ তৃতীয় পারা, সূরা আল-ইমরান ৮১-৮২ নং আয়াত।

এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হলো (১) আয়াতের ইবারাতুন নস-এর দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, অন্যান্য নবীগণ থেকে আল্লাহ তায়ালা অঙ্গীকার আদায় করেছিলেন। (২) দালালাতুন নস- এর দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, সমস্ত নবীগণ সেদিন মাহফিলে উপস্থিত ছিলেন। (৩) ইশারাতুন নস- এর দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, মূলত ঐ মাহফিলটি নবীজীর আগমনী বা মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর মাহফিল ছিল। (৪) ইক্বতেজাউন নস- এর দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, ঐ সময় সমস্ত নবীগণ কি্বয়াম অবস্থায় ছিলেন। কারণ ঐ দরবারে বসার কোন অবকাশ নেই এবং পরিবেশটিও ছিল আদবের।

আরো লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে- এই আয়াতে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন ‘মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অর্থাৎ নবীজীর আগমন সম্পর্কে রোজ আজলের মধ্যে সমস্ত নবীগণকে উপস্থিত রেখে আলোচনা করেছেন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন প্রিয় আল্লাহর রাসূল, তাঁর সাথে মানুষের তুলনা হবেতো দূরের কথা, অন্য কোনো নবীর ও তুলনা হয়না। এজন্যই আল্লাহ তায়ালা সমস্ত নবীদের নিকট দুটি হুশিয়ারী বাণী প্রদান করেছেন। যথা- (১) আমার বন্ধুর উপর ঈমান আনতে হবে। (২) আমার বন্ধুকে সর্বোত্তমভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতে হবে।

মানুষ যখন কোনো নেয়ামত ও রহমত প্রাপ্ত হয় তখন তার জন্য আনন্দ উৎসব করা তার স্বভাবগত কাজ, আর আল্লাহর নির্দেশও তাই। যেমন- পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন-

অর্থাৎ- হে মানবকুল তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং অন্তর সমূহের বিশুদ্ধতা, হেদায়াত এবং রহমত ঈমানদারদের জন্য। হে হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনি বলুন! আল্লাহরই অনুগ্রহ ও তাঁর দয়া প্রাপ্তিতে তারা যেন আনন্দ প্রকাশ করে। এটা তাদের সমস্ত ধন দৌলত সঞ্চয় করা অপেক্ষা শ্রেয়। (সূরা ইউনুছ, আয়াত নং- ৫৭-৫৮)।

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ূতী (রহঃ) তাঁর তাফসীর গ্রন্থ আদ দুররুল মুনছুর এ উল্লেখ করেন-

অর্থাৎ- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) এ আয়াতের তাফসীরে বলেন এখানে আল্লাহর অনুগ্রহ (ফাদ্বলুল্লাহ) দ্বারা ইলমে দ্বীন বুঝানো হয়েছে আর (রহমত) দ্বারা সরকারে দু’আলম নূরে মোজাচ্ছম আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বুঝানো হয়েছে। যেমন- আল্লাহ তায়ালা বলেন, (ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতালি্লল আলামীন) অর্থাৎ হে হাবীব আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত করেই প্রেরণ করেছি।

(*)সূত্রঃ সূরা আম্বিয়া আয়াত নং- ১০৭, তাফসীরে রুহুল মায়ানী, তাফসীরে কবির ও ইমাম সূয়ূতী (রহঃ) কৃত তাফসীরই আদ দুররুল মুনছুর, ৪র্থ খন্ড- ৩৬ পৃষ্ঠায় ও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।

সামান্য জাগতিক নিয়ামত লাভ করলে তজ্জন্য ঈদ উৎসব করার সরাসরি উদাহরণ আমরা পবিত্র কুরআন মাজীদে দেখতে পাই। যেমন-

অর্থাৎ- মরিয়ম তনয ঈসা (আঃ) আরয করলেন, হে আল্লাহ! হে আমাদের রব, আমাদের উপর আকাশ থেকে একটা খাদ্য খাঞ্চা অবতরণ করুন যা আমাদের ও আমাদের পূর্ববর্তী সকলের জন্য ঈদ হবে এবং আপনারই নিদর্শন হবে, সুতরাং আমাদেরকে রিযিক দান করুন। আর আপনিইতো হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ রিযিক দাতা। (সূরা মায়েদা, আয়াত নং- ১১৪)।

এ আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে খাঞ্চাভরা খাদ্য আসলে তা যদি হযরত ঈসা (আঃ)-এর ভাষায় পূর্ব ও পরবর্তী সকলের জন্য আনন্দ, উৎসবের কারণ ও আল্লাহর নিদর্শন হয়, তাহলে সৃষ্টির মধ্যে সর্বোত্তম সত্ত্বা, রহমতের ভান্ডার, প্রিয় নবী আকাও মাওলা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার মত মহান নিয়ামতের শুভাগমনের দিন কতইনা মর্যাদাবান, গুরুত্বপূর্ণও আনন্দের দিন বা মাস তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

রাসুল (স:) পবিত্র ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’  পালন ক‌রে‌ছেন  কিনা ?

ইমাম বায়হাকী (রহ:) হযরত আনাস (রা:) থেকে বর্ণনা করেন:

 ‘হুযূর পাক (দ:) নবুয়্যত প্রাপ্তির পর নিজের নামে আকিকাহ করেন; অথচ তাঁর দাদা আবদুল মোত্তালিব তাঁরই বেলাদতের সপ্তম দিবসে তাঁর নামে আকিকাহ করেছিলেন, আর আকিকাহ দু’বার করা যায় না। 

অতএব, রাসূলে খোদা (দ:) বিশ্বজগতে আল্লাহর রহমত হিসেবে প্রেরিত হওয়ায় মহান প্রভুর দরবারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যে এটি করেছিলেন, 

 তাঁর উম্মতকে সম্মানিত করার জন্যেও, 

যেমনি ভাবে তিনি নিজের ওসীলা দিয়ে দোয়া করতেন। 

তাই আমাদের জন্যেও এটি করা উত্তম হবে যে আমরা মীলাদুন্নবী (দ:) দিবসে কৃতজ্ঞতা সূচক খুশি প্রকাশার্থে আমাদের দ্বীনী ভাইদের সাথে সমবেত হই, 

মানুষদেরকে খাবার পরিবেশন করি এবং অন্যান্য সওয়াবদায়ক আমল পালন করি।’ 

এই হাদীস পূর্বোক্ত মহানবী (দ:)-এর দ্বারা মীলাদ ও নবুয়্যত-প্রাপ্তির দিবস পালনার্থে সোমবার রোযা রাখার হাদীসকে সমর্থন দেয়।

— হুসনুল মাকসাদ ফী আমলিল মওলিদ, ৬৪-৬৫ পৃষ্ঠা

খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে পবিত্র ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিল কি-না?

আল্লামা শাহাবুদ্দীন ইবনে হাজর হায়তামী (রহঃ) বলেন, খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগেও ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পালন করার নীতি প্রচলন ছিল। যেমন-

অর্থাৎ - হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) বলেছেন- “যে ব্যক্তি ‘মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঠ করার জন্য এক দিরহাম অর্থ খরচ করবে, সে ব্যক্তি বেহেশ্তে আমার সাথী হবে”। হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) বলেছেন- “যে ব্যক্তি ‘মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাজীম ও সম্মান করলো, সে যেন ইসলামকেই জীবিত রাখলো”। হযরত ওসমান (রাঃ) বলেছেন- “যে ব্যক্তি ‘মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঠ করার জন্য এক দিরহাম অর্থ খরচ করলো, সে যেন বদর ও হোনাইনের যুদ্ধে শরীক হলো”। হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন- “যে ব্যক্তি ‘মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্মান করবে এবং মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঠ করার উদ্যোক্তা হবে, সে দুনিয়া থেকে (তওবার মাধ্যমে) ঈমানের সাথে বিদায় হবে এবং বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে”। 

(*)সূত্রঃ আন নে’মাতুল কোবরা আলাল ফি মাওলিদি সাইয়্যেদ ওলদে আদম ৭-৮ পৃষ্ঠা।

সাহাবা আজমায়ীন গনের মিলাদুন্নবি (স:) :

পবিত্র হাদিস শরীফে এরশাদ হয়েছে "

ﻋَﻦْ ﺍَﺑِﻰ ﺍﻟﺪَّﺭْﺩَﺍﺀِ ﺭَﺿِﻰَ ﺍﻟﻠﻪُ ﺗَﻌَﺎﻟٰﻰ ﻋَﻨْﻪُ ﺍَﻧَّﻪﻣَﺮَّ ﻣَﻊَ ﺍﻟﻨَّﺒِﻰِّ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠﻪُ

ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ ﺍِﻟٰﻰﺑَﻴْﺖِ ﻋَﺎﻣِﺮِ ﺍﻻَﻧْﺼَﺎﺭِﻯِّ ﻭَﻛَﺎﻥَ ﻳُﻌَﻠِّﻢُ ﻭَﻗَﺎﺋِﻊَﻭِﻻﺩَﺗﻪِ ﺻَﻠَّﻰ

ﺍﻟﻠﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ ﻻَﺑْﻨَﺎﺋِﻪﻭَﻋَﺸﻪِﺗَﺮْﻴِ ﻭَﻳَﻘُﻮْﻝُ ﻫٰﺬَﺍ ﺍﻟْﻴَﻮْﻡَ ﻫٰﺬَﺍ ﺍﻟْﻴَﻮْﻡَﻓَﻘَﺎﻝَ

ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﺍﻟﺼَّﻠٰﻮﺓُ ﻭَﺍﻟﺴَّﻼﻡُ ﺍِﻥَّ ﺍﻟﻠﻪَ ﻓَﺘَﺢَﻟَﻚَ ﺍَﺑْﻮَﺍﺏَ ﺍﻟﺮَّﺣْﻤَﺔِ ﻭَﺍﻟْﻤَﻼﺋِﻜَﺔُ

ﻛُﻠُّﻬُﻢْﻳَﺴْﺘَﻐْﻔِﺮُﻭْﻥَ ﻟَﻚَ ﻣَﻦْ ﻓَﻌَﻞَ

ﻓِﻌْﻠَﻚَ ﻧَﺠٰﻰﻧَﺠٰﺘَﻚ

অর্থাৎ হজরত আবু দ্বারদা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু  হতে বর্ণিত ,  

দয়াল রাসূল পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন হজরত আমির আনসারী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু  এর গৃহে গেলেন এবং হুজুর  পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  দেখতে পেলেন আমির আনসারী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু  উনার পরিবার পরিজন ও আত্বীয় স্বজনদের নিয়ে একত্রিত হয়ে খুশি মনে রাসুল পুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিলাদত শরীফ পাঠ করছেন | 

অর্থাৎ নবীজি এইদিনে পৃথিবীতে আসছেন , 

পৃথিবীতে প্রত্যেকটা মাখলুক আনন্দিত হয়েছে  ইত্যাদি | 

এই ঘটনা শ্রবণ করে হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে হজরত আমির আনসারীকে বললেন ,

 আল্লাহ পাক তোমার জন্য উনার রহমতের দরজা প্রশস্ত করেছেন এবং সমস্ত ফেরেস্তাগন তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছেন | 

 যে কেউ তোমাদের মত এইরূপ কাজ করবে সেও তোমাদের মত রহমত ও মাগফিরাত লাভ করবে এবং নাজাত লাভ করবে |

 (*)সূত্রঃ  কিতাবুত তানবীর ফী মাওলিদিল বাশীর ওয়ান নাযীর, সুবুলুল হুদা ফী মাওলিদে মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হাকীকতে মোহাম্মদী ও মীলাদে আহমদী : পৃষ্ঠা ৩৫৫)

আওলিয়া কেরামের পবিত্র মিলাদুন্নবী (স:) পালন:

প্রসিদ্ধ তাবেঈ হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেন--

ﻗﺎﻝ ﺣﺴﻦ ﺍﻟﺒﺼﺮﻱ ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﯽ ﻋﻨﻪ ﻭﺩﺩﺕ ﻟﻮ ﮐﺎﻥ ﻟﯽ ﻣﺜﻞ ﺟﺒﻞ ﺍﺣﺪ ﺫﮬﺒﺎ ﻓﺎﻧﻔﻘﺘﻪ ﻋﻠﯽ ﻗﺮﺍﺀﺓ ﻣﻮﻟﺪ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﺻﻠﯽ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﯿﻪ ﻭﺳﻠﻢ

অর্থাৎ-আমার একান্ত ইচ্ছা হয় যে,

 আমার যদি ওহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ’ থাকতো তাহলে তা মিলাদুন্নবী (সাঃ) উপলক্ষে ব্যয় করতাম ।

— আন নেয়মাতুল কুবরা আলাল আলাম, পৃষ্ঠা নং-১১

শাফেয়ী মাযহাবের ইমাম হযরত শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন-

قَالَ اَلاِمَامُ الشَّافِعِىُّ رَحِمَهُ اللهُ مَنْ جَمَعَ لِمَوْلِدِ النَّبِىِّ صَلّٰى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ اِخْوَانًا وَهَيَّاَ طَعَامًا وَاَخْلٰى مَكَانًا وَعَمَلَ اِحْسَانًا وَصَارَ سَبَبًا لِقِرَائَتِهٖ بَعَثَهُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَعَ الصِّدِّيْقِيْنَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِيْنَ وَيَكُوْنُ فِىْ جَنَّاتِ النَّعِيْمِ.

অর্থ: ‘যে ব্যক্তি পবিত্র মীলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদযাপন উপলক্ষে লোকজন একত্রিত করলো, খাদ্য তৈরি করলো, জায়গা নির্দিষ্ট করলো এবং এ জন্য উত্তমভাবে তথা সুন্নাহ ভিত্তিক আমল করলো তাহলে উক্ত ব্যক্তিকে আল্লাহ পাক হাশরের দিন ছিদ্দীক্ব, শহীদ সালিহীনগণের সাথে উঠাবেন এবং উনার ঠিকানা হবে জান্নাতে নায়ীমে।’ সুবহানাল্লাহ!

(*) সূত্র: আন নি'মাতুল কুবরা আলাল আলাম ১০ পৃষ্ঠা ।

ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বপ্রথম মোহাদ্দিস হযরত শায়খ আবদুল হক মোহাদ্দেসে দেহলভী রহমাতুল্লাহে আলাইহি বলেন-

“যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রাত্রকে ঈদ হিসেবে পালন করে, 

তার উপর আল্লাহ তায়ালা রহমত নাযিল করেন। 

আর যার মনে হিংসা এবং [নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দুশমনির] রোগ রয়েছে, তার ঐ (নবী বিদ্বেষী) রোগ আরও শক্ত আকার ধারণ করে”।

[মা সাবাতা বিসসুন্নাহ (উর্দু) পৃষ্ঠা নং-৮৬]

পবিত্র মিলাদুন্নবী (স:) এর গুরুত্ব তুলে তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া কয়েকটা ঘটনার মধ্যে নিম্নে একটা উল্লেখ করলাম:

 হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী রহমাতুল্লাহে আলাইহি তার রচিত “আদ দুররুস সামীন ফী মুবাশশারাতিন নবীয়্যিল আমীন” 

কিতাবের ৯ম পৃষ্ঠায় লিখেছেনঃ

“আমার শ্রদ্ধেয় আব্বাজান আমাকে অবহিত করে বলেন, আমি প্রতি বছরই নবীকুল সর্দার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মীলাদ উপলক্ষ্যে বিরাট খাবার আয়োজন করে আসছিলাম। 

অতঃপর এক বছর খাবারের আয়োজন করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। 

সুতরাং অল্প ভাজ্যকৃত চনা ব্যতীত আর কিছুই আমি জোগাড় করতে পারিনি। 

কাজেই সেগুলো উপস্থিত লোকদের মাঝে বন্টন করে দিলাম। অতঃপর আমি স্বপ্নে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাক্ষাত লাভ করে ধন্য হলাম। 

দেখলাম, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সামনে ঐ চনাগুলো মওজুদ আছে। 

তখন হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন অত্যন্ত আনন্দিত ও হাস্যোজ্জল”।

[(*) সূত্র: ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদযাপন, পৃষ্ঠা নং-৮১, ফতুয়ায়ে রশীদিয়া, পৃষ্ঠা নং- ১৩৭, হাকিকতে মীলাদ, পৃষ্ঠা নং-২৮]

হযরত ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন-

قَالَ سُلْطَانُ الْعَارِفِيْنَ الْاِمَامُ جَلالُ الدِّيْنِ السُّيُوْطِىُّ قَدَّسَ اللهُ سِرَّهٗ وَنَوَّرَ ضَرِيْحَهُ فِىْ كِتَابِهِ الُمُسَمّٰى الْوَسَائِلِ فِىْ شَرْحِ الشَّمَائِلِ" مَا مِنْ بَيْتٍ اَوْ مَسْجِدٍ اَوْ مَحَلَّةٍ قُرِئَ فِيْهِ مَوْلِدُ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اِلا حَفَّتِ الْمَلٰئِكَةُ ذٰلِكَ الْبَيْتَ اَوِ الْمَسْجِدَ اَوِ الْمَحَلًّةَ صَلَّتِ الْمَلٰئِكَةُ عَلٰى اَهْلِ ذٰلِكَ الْمَكَانِ وَعَمَّهُمُ اللهُ تَعَالٰى بِالرَّحْمَةِ وَالرِّضْوَانِ واَمَّا الْمُطَوَقُّوْنَ بِالنُّوْرِ يَعْنِىْ جِبْرَائيلَ وَمِيْكَائِيْلَ وَاِسْرَافِيْلَ وَعَزْرَائِيْلَ عَلَيْهِمُ السَّلامُ فَاِنَّهُمْ يُصَلُّوْنَ عَلٰى مَنْ كَانَ سَبَبًا لِقَرَائَةِ مَوْلِدِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَاِذَا مَاتَ هَوَّنَ اللهُ عَلَيْهِ جَوَابَ مُنْكِرٍ وَنَكِيْرٍ وَيَكُوْنُ فِىْ مَقْعَدِ صِدْقٍ عِنْدَ مَلِيْكٍ مُّقْتَدِرٍ.

অর্থ: “যে কোন ঘরে অথবা মসজিদে অথবা মহল্লায় পবিত্র মিলাদ্দুনবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদযাপন করা হয় সেখানে অবশ্যই আল্লাহ পাক- উনার ফেরেশতাগণ বেষ্টন সৃষ্টি করে নেন। আর উনারা সে স্থানের অধিবাসীগণের উপর ছলাত-সালাম পাঠ করতে থাকেন।

আর আল্লাহ পাক উনাদেরকে স্বীয় রহমত ও সন্তুষ্টির আওতাভুক্ত করে নেন। 

আর তার নূর দ্বারা সজ্জিত প্রধান চার ফেরেশতা অর্থাৎ হযরত জিবরায়ীল, মীকায়ীল, ইসরাফীল ও আযরায়ীল আলাইহিমুস সালামগণ মীলাদুন নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদযাপনকারীগণের উপর ছলাত-সালাম পাঠ করেন।

 যখন উনারা ইনতিকাল করেন তখন আল্লাহ পাক উনাদের জন্য মুনকার-নাকীরের সুওয়াল-জাওয়াব সহজ করে দেন। 

আর উনাদের অবস্থান হয় আল্লাহ পাক- উনার সন্নিধানে ছিদ্দিক্বের মাক্বামে।” সুবহানাল্লাহ্!

(*) সূত্র:

* ওয়াসিল ফি শরহে শামায়িল

* আন নিয়ামাতুল কুবরা আলাল আলাম ১০ পৃষ্ঠা।

 

ইমাম ইবনে কাসীর (রঃ) বলেন-

আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া উর্দু কিতাবের প্রচ্ছদ---

আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া উর্দু কিতাবের যে অংশে ইবনে কাসির (রহঃ) মিলাদ শরীফের পক্ষে লিখেছেন

ইবনে কাসীর, যাকে সালাফী/ওহাবীরা তাফসীর ও ইতিহাস শাস্ত্রে সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করে থাকে, তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় ইসলামের মুজাহিদ সুলতান গাযী সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর ভগ্নিপতি শাহ মালিক আল-মুযাফফর সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন।

 অথচ সালাফীরাই ইবনে কাসীরের কথাকে বিকৃত করে এই মর্মে মিথ্যে ছড়িয়েছে যে মুযাফফর শাহ একজন ফাসেক, নিষ্ঠুর ও বেদআতী শাসক ছিলেন (নাউযু বিল্লাহ)। 

প্রকৃতপক্ষে ইবনে কাসীর লিখেন:

أحد الاجواد والسادات الكبراء والملوك الامجاد له آثار حسنة وقد عمر الجامع المظفري بسفح قاسيون وكان قدهم بسياقه الماء إليه من ماء بذيرة فمنعه المعظم من ذلك واعتل بأنه قد يمر على مقابر المسلمين بالسفوح وكان يعمل المولد الشريف في ربيع الاول ويحتفل به احتفالا هائلا وكان مع ذلك شهما شجاعا فاتكا بطلا عاقلا عالما عادلا رحمه الله وأكرم مثواه وقد صنف الشيخ أبو الخطاب ابن دحية له مجلدا في المولد النبوي سماه التنوير في مولد البشير النذير فأجازه على ذلك بألف دينار وقد طالت مدته في الملك في زمان الدولة الصلاحية وقد كان محاصر عكا وإلى هذه السنة محمودالسيرة والسريرة قال السبط حكى بعض من حضر سماط المظفر في بعض الموالد كان يمد في ذلك السماط خمسة آلاف راس مشوى وعشرة آلاف دجاجة ومائة ألف زبدية وثلاثين ألف صحن حلوى

(মুযাফফর শাহ) ছিলেন একজন উদার/সহৃদয় ও প্রতাপশালী এবং মহিমান্বিত শাসক, যাঁর সকল কাজ ছিল অতি উত্তম। তিনি কাসিইউন-এর কাছে জামেয়া আল-মুযাফফরী নির্মাণ করেন.....(প্রতি) রবিউল আউয়াল মাসে তিনি জাঁকজমকের সাথে মীলাদ শরীফ (মীলাদুন্নবী) উদযাপন করতেন। উপরন্তু, তিনি ছিলেন দয়ালু, সাহসী, জ্ঞানী, বিদ্বান ও ন্যায়পরায়ণ শাসক - রাহিমুহুল্লাহ ওয়া একরাম - শায়খ আবুল খাত্তাব (রহ:) সুলতানের জন্যে মওলিদুন নববী সম্পর্কে একখানি বই লিখেন এবং নাম দেন ‘আত্ তানভির ফী মওলিদ আল-বাশির আন্ নাযীর’।

 এ কাজের পুরস্কারস্বরূপ সুলতান তাঁকে ১০০০ দিনার দান করেন। সালাহিয়া আমল পর্যন্ত তাঁর শাসন স্থায়ী হয় এবং তিনি ’আকা’ জয় করেন। 

তিনি সবার শ্রদ্ধার পাত্র থেকে যান। আস সাবত এক ব্যক্তির কথা উদ্ধৃত করেন যিনি সুলতানের আয়োজিত মওলিদ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন; 

ওই ব্যক্তি বলেন:

 ‘অনুষ্ঠানে সুলতান ভালভাবে রান্নাকৃত ৫০০০ ছাগল, ১০,০০০ মোরগ, ১ লক্ষ বৌল-ভর্তি দুধ এবং ৩০,০০০ ট্রে মিষ্টির আয়োজন করতেন’।

(*) সূত্র: তারিখে ইবনে কাসীর, ‘আল-বেদায়াহ ওয়ান নেহায়া’ ১৩তম খণ্ড, ১৭৪ পৃষ্ঠা।


 দেশে দেশে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)

যেভাবে শুরু

পৃথিবীর বুকে জন্ম নেওয়া সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানুষ হজরত মুহাম্মদ (সা.)। মুসলমান মাত্রই নয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেন যে, ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের আরবি ১২ রবিউল আউয়ালে আরবের তৎকালীন অন্ধকার যুগে ইসলামের মহান নেতা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম সমগ্র মানবজাতির জন্য ছিল আশীর্বাদস্বরূপ। তাঁর মাধ্যমেই মহান রাব্বুল আলামিন পৃথিবীতে আসমানি গ্রন্থ পবিত্র কোরআন নাজিল করেন, যা সর্বকালে মানুষের পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান ও পথপ্রদর্শনের জন্য যথেষ্ট। এই পবিত্র কোরআনের ৩৩ নম্বর সূরা আল আজহাবের ৫৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ এবং তার ফেরেশতারাও নবীর জন্য দোয়া করেন। হে বিশ্বাসীগণ তোমরাও নবীর জন্য দোয়া কর ও পূর্ণ শান্তি কামনা কর।’ পবিত্র এই বাণীর আলোকে মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর পর বিভিন্ন পদ্ধতি বা আচার অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনেক ক্ষেত্রে তা স্থানীয় কৃষ্টি, সভ্যতা ও লৌকিকতার মিশ্রণে নতুন রূপ লাভ করে। আরব বিশ্ব কাব্য সাহিত্যে বিশেষ সমৃদ্ধ ছিল বিধায় কবিতার ছন্দে মহানবী (সা.)-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও তাঁর জন্য দোয়া করা দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। ছন্দের সঙ্গে সুরের সংমিশ্রণে নাতে রসুল (সা.) চালু হয়। পরে ছন্দ ও সুরের সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার শুরু হলে বিভক্তি দেখা দেয় মুসলমান সমাজে। আবার সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে ওহাবি আন্দোলনের বিস্তার মহানবী (সা.) এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং দরুদ ও সালাম পেশের পদ্ধতিকে অতিমাত্রায় সীমিত করে ফেলে বলে অনেক নবীপ্রেমিক ও সুফিবাদে বিশ্বাসীদের অভিযোগ। তবে এ কথা সত্য, অভিযোগ থাকলেও মহানবী (সা.)-এর জন্মদিনে নিজস্ব রীতিনীতিতে তার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনে বদ্ধপরিকর দেশ-বিদেশের লাখো কোটি মুসলমান।

শোভাযাত্রা ও সমাবেশ (লিবিয়া)

উত্তর আফ্রিকার এক বৃহৎ রাষ্ট্র লিবিয়া, ভূমধ্যসাগর ও অন্যান্য আফ্রিকান দেশের মাঝে অবস্থিত এই দেশে সপ্তম শতকে ইসলামের বিস্তার শুরু হয়। তবে বিভিন্ন আরব রাষ্ট্র এবং লিবিয়ার পূর্বে অবস্থিত শহর থেকে তৎকালে প্রচলিত কাফেলা, বেদুঈন, ধর্ম প্রচারক এবং সুফি দরবেশদের মধ্যে একাদশ শতকে লিবিয়ায় ইসলামের প্রচার ও প্রসার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে লিবিয়ার জনসংখ্যা ৭২ লাখ যার ৯৬.৬ শতাংশই মুসলমান। দেশটির মুসলমানদের মধ্যে অধিকাংশ সুফি মতবাদে বিশ্বাস করে এবং প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মদিন পালনে সুফি মতবাদে প্রচলিত আনুষ্ঠানিকতা অনুসরণ করে। রাজধানী ত্রিপোলিসহ লিবিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বিখ্যাত কিছু সুফি মতানুসারী নিয়ন্ত্রিত মসজিদ রয়েছে, যেখানে যথাযথ মর্যাদায় ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালিত হয়। এই দিনে দেশটিতে ছুটি পালন করা হয় এবং প্রাচীন ঐতিহ্যে বিভিন্ন শহরের রাস্তায় শোভাযাত্রা বের করা হয়। এসব মিছিলে সমবেতভাবে ভক্তিমূলক গান ও নাতে রসুল (সা.)-এর মাধ্যমে মহানবী (সা.)-এর মাহাত্ম্য বন্দনা করা হয়। সেই সঙ্গে মিছিলে বিশেষ ধরনের ঢোল ও বড় মন্দিরা বা ট্রাম্পেট বাজান হয়। মিছিল বা শোভাযাত্রা শেষে রসুল (সা.)-এর ভক্তরা একটি স্থানে সমবেত হয় যেখানে একজন ধর্মীয় নেতা ইসলাম এবং হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শের বক্তব্য রাখেন। বর্তমানে বিরাজমান যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে আগের মতো জৌলুসের সঙ্গে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালনে কিছুটা ভাটা পরিলক্ষিত হয়। এ ছাড়াও সৌদি আরব থেকে ওহাবি মতবাদ ছড়িয়ে পড়ায় লিবিয়ায় সালাফি মতাদর্শের বিস্তার ঘটেছে, যারা গোঁড়া সুফিদের মতো জাঁকজমকের সঙ্গে মিলাদুন্নবী (সা.) পালনে বিরোধিতা করে। গৃহযুদ্ধের কারণে কয়েক বছর কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই মিলাদুন্নবী (সা.) পালিত হলেও সাম্প্রতিককালে আবারও শুরু হয়েছে এই বিশেষ দিনের আনুষ্ঠানিকতা ও আনুষ্ঠানিক ইবাদত-বন্দেগি। এ সময় উৎসবের আমেজে রাস্তায় দোকানপাট বসে এবং শিশুদের খেলনা বিক্রি হয়। এ ছাড়াও ঐতিহ্যবাহী বর্ণিল পোশাকে শিশুরা আনন্দে মেতে ওঠে। আধুনিকতার পরশে সাম্প্রতিককালের মিছিলে রঙিন ও আলোকিত ছাতা এবং বেলুনের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়।

সিকাতেন উৎসব (ইন্দোনেশিয়া)

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম দ্বীপ রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া। বর্তমানে দেশটির জনসংখ্যা ২৭ কোটিরও বেশি, যার প্রায় ৮৮ শতাংশই মুসলমান। সেই হিসাবে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মুসলমানের বসবাস ইন্দোনেশিয়ায়। আবার মুসলমানদের মধ্যে ৯৯ শতাংশ সুন্নি হওয়ায় পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বড় সুন্নিপ্রধান দেশও ইন্দোনেশিয়া। তবে ইন্দোনেশিয়া কোনো ইসলামিক বা মুসলমান রাষ্ট্র নয়, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ত্রয়োদশ শতকে আরবসহ অন্যান্য মুসলমান দেশের বাণিজ্যিক জাহাজ ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন দ্বীপে ব্যাপকভাবে নোঙর ফেলত এবং জাহাজে আসা মুসলমান ব্যবসায়ী ও শ্রমিক-কর্মচারীরা স্থানীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করত। তখন স্থানীয় অধিবাসী এবং শাসক শ্রেণি  মুসলমানদের সততা, ব্যবহার ও জীবনাচারে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ শুরু করে। পরে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে ধর্ম প্রচার করে নিরলস পরিশ্রমে বিশ্বের বুকে ইন্দোনেশিয়া আজ জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বের সর্ববৃহৎ দেশ। আরবি শাইহাদাতাইন ‘কিংবা শাহাদাহ’ শব্দের অনেক অর্থের একটি হলো সাক্ষ্য দেওয়া বা স্বীকার করে নেওয়া। এই শাইহাদাতাইন শব্দ থেকেই ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় ভাষায় সিকাতেন নামক একটি শব্দের উৎপত্তি, যা মূলত ১২ রবিউল আউয়াল ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপপুঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উৎসব পালনকে বুঝায়। উল্লেখ্য, ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা এই জাভা দ্বীপপুঞ্জেই অবস্থিত। তাই এই সিকাতেন বা মিলাদুন্নবী (সা.) উৎসবে ব্যাপক মুসলমানের একাত্মতা লক্ষ্য করা যায়। ইতিহাস অনুসন্ধানে দেখা যায় জাকার্তার শাসক সুলতান হামেং কুবুওয়ানারের আমলে এই উৎসব শুরু হয়। নবীপ্রেমিক সুলতান হামেং কুবুওয়ানা ইন্দোনেশিয়ায় ইসলাম বিস্তারে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। তাই তিনি একটি উৎসবের মাধ্যমে ইসলামের মর্মবাণী ও মহানবী (সা.)-এর জীবনী সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সেদিনের সেই ছোট্ট উৎসব আজ ব্যাপক ব্যাপ্তি পেয়েছে। বর্তমানে জাকার্তাসহ ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে সাকাতেন বা ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে সাত দিনব্যাপী উৎসব হয়। এই উৎসবে স্থানীয় সংস্কৃতির মিশ্রণে মহানবী (সা.)-এর জীবনী আলোচনা হয় এবং অন্যান্য ইবাদত করা হয়। বিশেষত্ব ১২ রবিউল আওয়াল তারিখে বিভিন্ন মসজিদ ও বাসাবাড়িতে ব্যাপকভাবে নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতায় স্মরণ করা হয় ইসলামের প্রবক্তা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে। এ উপলক্ষে সারা রাত মেলার আদলে রাস্তাঘাট ও বাজারে বেচাকেনা চলে। ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে বড় বড় ডেকচিতে নারিকেল, বাদাম, চিংড়ি ও মরিচের সংমিশ্রণে বিশেষ ধরনের ভাত রান্না করা হয়, যা স্থানীয়ভাবে সিগোগরিই নামে পরিচিত। এমনি ধরনের আরেকটি খাবার হলো গুগুনগান যা তৈরি হয় জাউভাত, বাদাম, সবজি, মরিচ ও ডিমের সংমিশ্রণে, মুসলমানরা এই খাবার সংগ্রহ করে বাড়িতে নিয়ে যায় এবং পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে খায়। অনেকে আবার কিছু খাবার ফসলের মাঠে ছিটিয়ে দেয় আরও বেশি ফসলের আশায়।

তোপধ্বনি দিয়ে শুরু (পাকিস্তান)

সরকারিভাবে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃত বিশ্বের অন্যতম মুসলমান অধ্যুষিত দেশ পাকিস্তান। বর্তমানে দেশটিতে ২১ কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস, যার ৯৬ শতাংশ মুসলমান। ভৌগোলিকভাবে পাকিস্তানের পূর্বে-ভারত এবং পশ্চিমে ইরান। ফলে পাকিস্তানের শিল্পসাহিত্য, আচার-আচরণ, রীতিনীতি ও সংস্কৃতিতে ভারত ও ইরান তথা পারস্যের প্রবল প্রভাব লক্ষণীয়। এ ছাড়া সুফিবাদ প্রচার ও প্রসারের উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে পাকিস্তানের ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। ফলে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মবার্ষিকী তথা ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে সমগ্র পাকিস্তানে নানা আনুষ্ঠানিকতা সমগ্র বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কাড়ে। ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর এক মাস আগে থেকেই পাড়ামহল্লা ও রাস্তাঘাটে ছোট ছোট দোকান গড়ে ওঠে বিশেষ ধরনের ব্যাজ, সবুজ পতাকা, টুপি ও ব্যানারের পসরা নিয়ে। অন্যান্য দোকানেও এসব সুভ্যেনির পাওয়া যায়। মিলাদুন্নবী (সা.) আগমন উপলক্ষে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে ৩১ বার এবং অন্যান্য রাজ্যের রাজধানীতে ২১ বার তোপধ্বনি বা কামানের গোলা বিকট শব্দে ফাটিয়ে মহানবী (সা.)-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয় এবং ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর আগমন ঘোষিত হয়। এ সময় দেশটির সরকারি ও বেসরকারি  ভবনগুলোতে দিনে জাতীয় পতাকা ও রাতে  রং-বেরঙের আলোকসজ্জা সবাইকে মুগ্ধ করে। এ ছাড়া ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে ইসলাম ও মহানবী (সা.)-এর শিক্ষাবিষয়ক ব্যানার টাঙানো হয় রাস্তাঘাটে। শহরাঞ্চলে চলে সম্মেলন, আলোচনা সভা, প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইবাদত-বন্দেগি ও রোজা রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বড় আকারের মিলাদ মাহফিল ও মিলাদ শেষে তবারক হিসেবে বিরিয়ানি বিতরণ পাকিস্তানের ঐতিহ্যবাহী প্রথা। কোনো কোনো স্থানে নাতে রসুল (সা.), ইসলামী গান ও কাওয়ালি শোনা যায়। তবে সব ছাড়িয়ে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বড় সমাবেশ হয় পাকিস্তানের লাহোরে  অবস্থিত মিনার ই পাকিস্তান চত্বরে। রবিউল আওয়াল মাসের ১১ তারিখ রাতে মিনার ই পাকিস্তানে লক্ষাধিক মুসলমান মিলাদ মাহফিলের মাধ্যমে মহানবী (সা.)-এর প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান, দরুদ ও সালাম পেশ করেন এবং তবারক বিতরণ করেন। এ ছাড়া প্রায় প্রতিটি মুসলমান পরিবারে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে বিশেষ খাবার তৈরি হয় এবং প্রতিবেশী, নিকটাত্মীয় ও দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হয়।

সব পথ মিশে শ্রীনগরে (ভারত)

ভারতে বসবাসরত মুসলমানদের মধ্যে পাকিস্তানি মুসলমানদের অনুকরণে একই রীতিনীতি ও আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বিশাল দেশ হিসেবে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে নিজ এলাকার সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যমূলক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েও মুসলমানগণ মহানবী (সা.)-এর জন্মবার্ষিকী পালন করে থাকে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্ত শ্রীনগর এলাকার মুসলমানগণ। ইতিহাস মতে, ইংরেজি ১৬৩৫ সালে জনৈক সৈয়দ আব্দুল্লাহ মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর একটি পবিত্র দাড়ি ভারতের বিজাপুরে নিয়ে আসেন। তার পুত্র সৈয়দ হামিদের হাত ঘুরে পরবর্তীতে সেই পবিত্র দাড়ি মোবারক কাশ্মীরের ব্যবসায়ী নুরুদ্দিনের হাতে হস্তান্তরিত হয়। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছে এই সংবাদ পৌঁছলে তিনি এই দাড়ি মোবারক হজরত খাজা মঈনুউদ্দিন চিশতির দরগায় সংরক্ষিত রাখেন এবং এই পবিত্র দাড়ি নিজের কাছে রাখার দায়ে ব্যবসায়ী নূরুদ্দীনকে বন্দী করেন। ১৭০০ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেব নিজেই নূরুদ্দীনকে মুক্তি দেন এবং তার কাছে মহাপবিত্র দাড়ি ফেরত পাঠান।

তবে ইতিমধ্যে তার মৃত্যু ঘটলে পরিবারের অন্য সদস্যরা যথাযথ মর্যাদায় তা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন। এই উদ্যোগ থেকে একটি মাজার গড়ে ওঠে। যেখানে এই পবিত্র দাড়ি এখনো সংরক্ষিত আছে বলে জানা যায়। পরবর্তীতে এখানে একটি মসজিদ গড়ে ওঠে। বর্তমানে এলাকার মূল আকর্ষণ হলো, ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর দিন এই পবিত্র দাড়ি সবাইকে দেখার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। দুর্লভ সৌভাগ্য অর্জনের জন্য নবীপ্রেমিক লক্ষাধিক মুসলমান এই মসজিদ ও মাজারে জমায়েত হন এবং ইবাদত-বন্দেগির মধ্য দিয়ে রাত ও দিনটি অতিবাহিত করেন। তাদের অনেকেই মিলাদুন্নবী (সা.) পালনের জন্য নির্ধারিত দিনের বেশ আগেই মসজিদে অবস্থান শুরু করেন এবং ক্রমাগত ইবাদত-বন্দেগি করতে থাকেন। অন্যদিকে আজমির শরিফ এবং দিল্লির নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজার প্রাঙ্গণে ও পার্শ¦বর্তী মসজিদে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে ব্যাপক ইবাদত-বন্দেগি চলতে থাকে।

জশনে জুলুস (বাংলাদেশ)

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ঈদে মীলাদে হাবীবুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়োজন করেন, এবং ছুটি ঘোষনা করেন।

জাতীয় পর্যায়ে ঈদে মিলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পালন : স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম হাক্বানী আলেম –ওলামাদের সুসংগঠিত করে পবিত্র ইসলাম উনার সঠিক রুপ জনগনের সামনে তুলে ধরার উদ্যোগ গ্রহন করেন। তাঁর দিকনির্দেশনা ও পৃষ্ঠ পোষকতায় ঢাকার সীরাত মজলিস নামে ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে পবিত্র রবিউল আওয়াল শরীফ মাসে স্বাধীন বাংলাদেশে সর্ব প্রথম বৃহত্তর আঙ্গিকে ঈদে মীলাদে হাবীবুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাহফিল উদযাপনের কর্মসূচী গ্রহন করে। সরকার প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধ বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদ চত্বরে মাহফিলের শুভ উদ্বোধন করেন । সরকার প্রধান হিসেবে জাতীয়ভাবে ‌ঈদে মীলাদে হাবীবুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাহফিলের উদ্বোধন উপমহাদেশের ইতিহাসে প্রথম দৃষ্টান্ত । এরই ধারাবাহিকতায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনে প্রতি বছর জাতীয়ভাবে ঈদে মীলাদে হাবীবুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাহফিল উদযাপন হয়ে আসছে । ঈদে-মীলাদে হাবীবুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, শব-ই-কদর, শব-ই-বরাত উপলক্ষ্যে সরকারি ছুটি ঘোষনাও করেন। ( তথ্যসূত্রঃ আবু তাহের মুহাম্মদ মানজুর, ইসলামী চেতনা ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অবদান,ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা (ঢাকা:ই.ফা.বা. )জানুয়ারী-মার্চ-২০০৯ পৃ-৪১,মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান,মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও ইসলাম সম্প্রসারনে  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অবদান,অগ্রপথিক, জাতীয় শোক দিবস সংখ্যা, ঢাকা: ই.ফা.বা.)আগষ্ট-১৯৯৯,পৃ-২৪ )

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান রাষ্ট্রীয়ভাবে ঈদে মীলাদে হাবীবুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পালনের পর থেকে আজ অবধি বাইতুল মোকারমে ঈদে মিলাদে হাবীবুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পালন হয়ে আসছে।

পাকিস্তান এবং ভারতের মতো বাংলাদেশেও যথাযথ মর্যাদা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপযাপিত হয়। এ দিনটিকে সরকারি ছুটি হিসেবে গণ্য করা হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এ উপলক্ষে আলোচনা সভা, সেমিনার ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। তবে এ ক্ষেত্রে হালের নতুন সংযোজন হলো বিশাল শোভাযাত্রা, যা জশনে জুলুস নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ঢাকায় আসা পীর সাহেবরা তার অনুসারীদের নিয়ে এই শোভাযাত্রা করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে আরেকটি মহৎ উদ্যোগ হলো স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি।

সরকারিভাবে এ সময় রাস্তায় কালেমা খচিত পতাকা লাগানো হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভবনে রাতে আলোকসজ্জা করা হয়। মসজিদ, মাজার এবং বাড়ির অন্দর মহলেও চলে মিলাদ ও দরুদ পাঠের মহাযজ্ঞ। বিগত কয়েক বছর ধরে বন্দরনগরী চট্টগ্রামেও ব্যাপক আকারে জশনে জুলুস বা শোভাযাত্রা পরিলক্ষিত হয়। তাছাড়াও ১২ আউলিয়ার পুণ্যভূমিখ্যাত চট্টগ্রামের বিভিন্ন মাজারকে কেন্দ্র করে বড় আকারের মিলাদ এবং তবারক বিতরণ চট্টগ্রামের পুরনো ঐতিহ্য।

তথ্য সুত্র : ‌দৈ‌নিক প‌ত্রিকা , ইসলা‌মিক বই ও ইন্টার‌নেট ।

- জা‌হিদ  আহ‌মেদ  ও তার স্মৃ‌তি  প‌রিষদ।

শুক্রবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২০

পৃথিবীতে প্রথম জীবনে ব্যর্থ ব্যক্তিদের সফল হওয়ার কাহিনী ও সফলতা পাবার কিছু উপায়


 

পৃথিবীতে প্রথম জীবনে ব্যর্থ ব্যক্তিদের সফল হওয়ার কাহিনী ও সফলতা পাবার কিছু উপায় 

জীবনের যে কোন সময়ে ব্যর্থতা আসতে পারে কিন্তু তাতে ভেঙ্গে পড়া উচিত নয়। কারন জীবন থেমে থাকে না, আপনি না চাইলেও সময় গড়াবেই। ভবিষ্যতকে আপনি মোকাবেলা করতেই হবে। তাই অহেতুক আর কোন অজুহাত নয়, সামানের দিকে এগিয়ে চলুন আর ভুল থেকে শিক্ষা নিন ... মনে রাখবেন , একটা দুইটা স্টেজে পা পিছলে পড়ে গেলেই জীবনের দ্য এন্ড হয়ে যায় না। জীবনটা অনেএএএক বড়... আর ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগও অনেক ... 

আমাদের জীবনে অনেকগুলা ধাপ পার হতে হয়। একটা বা দুইটা ধাপে যদি কেও খারাপ করেও, তাহলে কি তাকে বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া ঠিক? যদি আপনি ঠিক মনে করেন, তাইলে নিচের লেখাগুলায় একটু চোখ বুলান।

একটা তথ্য – বিল গেটস, মার্ক জুকারবার্গ, স্টিভ জবস – এই তিনজনের মধ্যে একটা মিল আছে


 কোথায়? তারা তিনজনই ইউনিভার্সিটি ড্রপ আউট স্টুডেন্ট। জুকারবার্গের তাও ব্যাচেলর ডিগ্রি আছে, অন্য ২ জনের তাও নেই। 

যে হার্ভার্ড থেকে বিল গেটস কিছুই পান নাই, সেই হার্ভার্ডে তাকে আমন্ত্রন জানানো হলো সম্মান জনক ডক্টরেট ডিগ্রি গ্রহন আর সমাবর্তনে বক্ত্রিতা দেয়ার জন্য। তিনি বললেন “যাক এতদিনে আমার সিভিতে লেখার মত একটা কিছু পেলাম”

তিনি আর বলেন" 'আমি অনেক বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছি, কিন্তু কখনও প্রথম হতে পারি নি। অথচ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবীরা আমার কর্মচারী। "

--------------

পৃথিবীতে প্রচুর সফল মানুষ আছেন যারা প্রথম জীবনে এক বা একাধিকবার ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়েছেন। জেনে নিন প্রথমে ব্যর্থ হয়েও জীবনে অবিশ্বাস্য সফলতার মুখ দেখা কিছু ব্যক্তি সম্পর্কে।

---------------

আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন মুচির দোকানে কাজ করতেন।

আবুল কালাম (ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি) ছিলেন গরীব ঘরের সন্তান। তাঁর বাবা ছিলেন একজন মাঝি। তবুও তিনি একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী হতে পেরেছিলেন।

নিকোলাস ক্রেজ 'ফেয়ারফ্যাক্স'¬ থিয়েটারে পপকর্ন বিক্রি করতো।

বিখ্যাত গায়ক বন জোভি প্রথম জীবনে বাড়িঘর সাজানোর ডেকোরেটরের কাজ করতো।

হলিউড অভিনেতা 'ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো' খ্যাত জনি ডেপ ছোটো বেলায় রাস্তায় রাস্তায় বল পয়েন্ট কলম বিক্রি করতো!

বলিউড অভিনেতা শাহরুখ খান মুম্বাইতে এসে বেঞ্চে ঘুমাতেন, প্রতিদিন কাজ খোজার জন্য বের হওয়ার আগে বন্ধুর কাছে ২০ টাকা করে ধার নিতেন।

আন্ড্রু কার্নেগী প্রচুর গরীব ঘরের ছেলে ছিলেন। তিনি একটি খামারে কাজ করতেন। পরে তিনি আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী ব্যক্তি হয়েছিলেন।

হলিউড অভিনেতা ব্রাড পিট প্রথম জীবনে 'এল পল্লো লোসো' নামের এক রেস্টুরেন্টে মোরগের ড্রেস পরে হোটেলবয় এর কাজ করতো।

থমাস এলভা এডিসনকে ছোটবেলায় সবাই বোকা, গাধা বলে রাগাত। তিনি পড়াশোনায় ভালো ছিলেন না। তবু তিনি একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী হতে পেরেছিলেন।

বিস্ময়কর ফুটবলার "মেসি" একসময় নিজের ফুটবলের ট্রেনিং এর খরচ যোগাতে চা দোকানে কাজ করতেন।

------------------------------------------------------------

জীবনের শুরুতে ব্যর্থ হয়েও অবিশ্বাস্য সফলতা পেয়েছেন বিখ্যাত ব্যক্তি

------------------------------------------------------------

১) উইস্টন চার্চিলঃ

তিনি মতাদর্শগত বিরোধের কারণে নিজের রাজনৈতিক পার্টি থেকে ১৯২৯ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন ছিলেন। এমন অবস্থা থেকেই ১৯৪০ সালে তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হন।

২) অপরাহ উইনফ্রেঃ

এই জনপ্রিয় মার্কিন টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব কুইন অফ টেলিভিশন টক শো নামে পরিচিত। ফোর্বস ম্যাগাজিন সূত্র মতে, ২.৯ বিলিয়ন ডলারের মালিক অপরাহ ক্যারিয়ার শুরু করেন টেলিভিশন উপস্থাপক হিসাবে যেখানে তিনি যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন।

৩) ওয়াল্ট ডিজনিঃ

বিখ্যাত মার্কিন চলচ্চিত্র প্রযোজক, কাহিনীকার ও অ্যানিমেটর ওয়াল্ট ডিজনি জীবনের প্রথমে নিউজ পেপার থেকে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন কল্পনাশক্তি এবং আইডিয়ার অভাব থাকার কারণে।

৪) স্টিফেন স্পিলবার্গঃ

বিখ্যাত পরিচালক ১৯৭৫ সালে ব্লকবাস্টার মুভি ‘Jews’ এর কারণে তিনটি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডস পেয়েছিলেন, এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। যদিও তিনি University of Southern California School of Cinematic Arts multiple times হতে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন।

৫) টমাস আলভা এডিসনঃ

বিখ্যাত এই বিজ্ঞানী ছোটবেলায় খুবই দূর্বল ছাত্র ছিলেন – শিক্ষকরা বলতেন, ‘সে কোন কিছু শিখতে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিতো।’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই মহান বিজ্ঞানী তিনি গ্রামোফোন, ভিডিও ক্যামেরা এবং দীর্ঘস্থায়ী বৈদ্যুতিক বাতিসহ বহু যন্ত্র তৈরি করেছিলেন, অর্জন করেছিলেন নিজের নামে এক হাজারেরও বেশি আবিষ্কারের পেটেন্ট।

৬) ডিক চেনিঃ

সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি। বিখ্যাত স্কুল ইয়েলের সংস্কৃতি এবং ক্লাসের সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে তিনি স্কুল ছেড়ে দিয়েছিলেন।

৭) স্যার আইজ্যাক নিউটনঃ

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের একজন আইজ্যাক নিউটন। আইজ্যাক নিউটনকে ছোটবেলায় তার মা স্কুলে যাওয়া থেকে বিরত রেখেছিলেন এবং পারিবারিক ফার্মের দায়িত্ব দেন, সেখানে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থতা হওয়ায় পুনরায় লেখাপড়ার সুযোগ পান তিনি এবং পরবর্তীতে পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন শাখায় সর্বোচ্চ সফলতা অর্জন করেন।

৮) আলবার্ট আইনস্টাইনঃ

আলোক-তড়িৎ ক্রিয়া সম্পর্কে গবেষণার জন্য নোবেল পুরষ্কার জয়ী এবং বিখ্যাত আপেক্ষিকতার তত্ত্ব আবিষ্কারক বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের ছোটবেলায় কথোপথন এবং শেখার ক্ষেত্রে আচরণগত কিছু সমস্যা ছিলো।

৯) জে কে রাউলিং:

জনপ্রিয় কল্পকাহিনী হ্যারি পটার সিরিজের রচয়িতা এবং একইসাথে বই বিক্রি করে প্রথম বিলিয়ন ডলার আয় করা জে কে রাউলিং যখন প্রথম হ্যারি পটার উপন্যাস শুরু করেন তখন তিনি সিংগেল মম হিসাবে কাজ করে জীবনধারণ করতেন।

১০) চালর্স ডারউইনঃ

বিবর্তনবাদের ধারণার আবিষ্কারক বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন ছোটবেলায় সাধারণ ছাত্র ছিলেন। মেডিসিনে ক্যারিয়ার গঠনের পথ থেকে সরে গিয়ে সামান্য যাজক হওয়ার জন্য স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন।

১১) হ্যারিসন ফোর্ডঃ

‘ইন্ডিয়ানা জোনস’ ও ‘স্টার ওয়ার্স’ খ্যাত, বিখ্যাত হলিউড অভিনেতা হ্যারিসন ফোর্ড প্রথম মুভিতে অভিনয়ের পর একজন সম্পাদক বলেছিলেন হ্যারিসন কখনও মুভিতে সফল হতে পারবেন না।

১২) ভিনসেন্ট ভ্যান গগঃ

পৃথিবীর সেরা চিত্র শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গগ ছিলেন অসম্ভব আবেগ প্রবণ আর আত্মবিশ্বাসহীন মানুষ। জীবন দশায় একটি মাত্র ছবি বিক্রি করতে পেরেছিলেন তাও মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে।

ব্যর্থতাই সফলতার চাবিকাঠি!! দেখে নিন ৫ বিলিয়নিয়ার যারা ব্যর্থ হতে হতে সফল হলেন!! তাদের সফলতার না বলা কথা!! 

---------------------------------------------------------------------

সফলতা সোনার হরিন। এই সোনার হরিনের পিছনে ছুটছি আমরা প্রতিনিয়ত। সফলতার সংজ্ঞা এক এক জনের কাছে এক এক রকম। তবে সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেন, ব্যর্থতা সফলতার পেছনের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যদিও এই তথ্যগুলো সব সময় বাস্তবে প্রয়োগ করা কঠিন হয়। তবে তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে আপনি জানলে অনেক কিছু করতে পারবেন। যেকারণে আপনাকে জানতে হবে এবং জানাতে হবে নিজেকে। আপনাকে প্রতিনিয়ত মানুষের ফিডব্যাক এবং সমালোচনাকে শুধরাতে হবে। তবে বার বার ব্যর্থ হতে থাকলে আপনি একদিন পিছিয়ে যাবেন নিজের কাছে। সেজন্যই আপনার তথ্য দরকার। আপনি যতো তথ্য জানবেন ততই আপনি নিজেকে ওভারকাম করতে পারবেন।

সফলতা একটি বিশেষ কোন বস্তু নয়, এটি অনেকগুলো কর্মকাণ্ডের সংমিশ্রণ। অনেকগুলো কাজের ফলাফল আপনার সফলতা। সফলতা ছুঁয়ে দেখা যায় না তবে আপনি অনুভব করতে পারবেন। আমরা সফল হতে চাই কিন্তু সফল হওয়ার পেছনের কষ্টগুলো নিতে চাই না। আমরা সফল মানুষের গল্প শুনতে ভালোবাসি কিন্তু সেই সফল মানুষের ভেতরের অনুভতিগুলাকে এড়িয়ে যায়। প্রত্যেকটা মানুষের সফল হওয়ার পেছনে থাকে বহু অনিদ্রা রাত যাপন, বহু বছরের কঠোর পরিশ্রম। সফলতা কখনো এক দিনে পাওয়া যায় না, সফল হতে বহু দিনের অক্লান্ত রাত পার করতে হয়।

 নিক উডম্যান - প্রতিষ্ঠাতাঃ GoPro

নিক ছিলেন পড়াশোনায় একজন বি ক্যাটাগরির স্টুডেন্ট। তিনি বিলিয়নিয়ার হিসাবে জন্মগ্রহণ করেননি। বর্তমানে তার GoPro ক্যামেরা প্রতিষ্ঠানের আগে তার দুইটা অনলাইন উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।

ব্যর্থতাঃ

প্রথমে তিনি ইম্পেয়ারওয়ল নামে যে ই-কমার্স সাইট তৈরি করেন, যেখানে তিনি কম মূল্যের ইলেক্ট্রনিকস পণ্য সেল করতেন। কোম্পানি খুব ভালো করতে পারছিল না, ফলে তিনি লছ করছিলেন, যেকারণে তিনি এই প্রতিষ্ঠান  বন্ধ করে দেন। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে  তিনি ফানবাগ নামে অনলাইন মার্কেটিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এই ওয়েব ছিল গেম নিয়ে কাজ। গেমের মাধ্যমে তিনি বিজনেস করতেন। যারা অংশগ্রহণ করতো তাদের ক্যাশপ্রাইজ দিতেন। এই কোম্পানি ৩.৯ মিলিয়ন অর্থ সংগ্রহ করে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে। কিন্তু ২০০১ সালে তিনি ব্যর্থ হতেই থাকেন। তিনি ক্লায়েন্টের কাছ থেকে ভালো ফিডব্যাক পাচ্ছিলেন না। যেকারনে তিনি এটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। এই বিজনেস থেকে তিনি ৪ মিলিয়ন ডলার লছ খান।

অবশেষে সফলতাঃ

দুইটি কোম্পানিতে লসের কারণে তিনি একটু ক্লান্ত হয়েছিলেন, যেকারনে তিনি রিফ্রেশমেন্টের জন্য দূরে বেড়াতে যান এবং সেখান থেকে ফিরে এই গোপ্রো ক্যামেরা নিয়ে কাজ শুরু করেন। বিশেষ করে যারা ভ্রমন প্রিয় এবং অ্যাথলেট। যদিও তিনি অনেক বার বলেছেন এই সময় তিনি অনেক ঝুঁকিতে থাকতেন এবং তা থেকে তিনি বের হতে চাইতেন।

অবশেষে তিনি বিশ্বের সবথেকে কমবয়সী বিলিয়নিয়ার হয়ে উঠেন এবং তার কোম্পানি গোপ্রো ছিল অ্যামেরিকার সবথেকে দ্রুত বেড়ে উঠা কোম্পানি।

২) বিল গেটসঃ

সম্পদের পরিমানঃ ৭২৭ কোটি ডলার

 জেমস ডাইসন

আমরা সবাই ভাবী সফল মানুষ সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত। এটা নীতিকথা হলেও সত্য ভিন্ন। সৃষ্টি মানুষের কঠোর শ্রমের ফল।

এখন যদিও আমরা দেখি জেমস ডাইসন একজন মোস্ট সফল ব্যক্তি। বিশ্বের সবথেকে নামকরা ব্যাগ লেস ভ্যাকুয়াম ক্লীনার্স এর প্রতিষ্ঠান তার। যা বিশ্বে ৫০ টিরও বেশি দেশে চলছে অবিরত। এটাই তাঁকে বিলিয়নিয়ার তৈরি করে। যদিও এর আগে তিনি এই প্রতিষ্ঠান গড়তে অনেক বার ব্যর্থ হন।

ব্যর্থতাঃ

এই ভ্যাকুয়াম তৈরির জন্য তিনি নান ধরণের আইডিয়া তৈরি করতেন, কিন্তু সবগুলা ব্যর্থ হতেই থাকে। এভাবে তিনি দিন দিন পরিবারকে কষ্ট দিচ্ছিলেন। কিন্তু কোন উপায় বের হচ্ছিলো না। তিনি হতাশ হতেন না, কিন্তু বাস্তবতা তাঁকে পিছনে ফেলে দিচ্ছিলো। তিনি নিজেকে এই কাজে উৎসর্গ করছিলেন, না হলে সফল হওয়া তার মটেও সাধতো না।

অবশেষে সফলতাঃ

ব্যর্থতা আপনার সফলতার পথপ্রদর্শক। আপনাকে নিরন্তর চেষ্টা করতেই হবে। ভেঙ্গে পড়লে কোনভাবেই হবে না। কিন্তু সফল ব্যক্তিরা এটাকে ব্যর্থতা না বলে ভিন্ন পথ বলে থাকেন। যেমন টমাস এডিসন ৯৯৯ বার ব্যর্থ হয়েও বলেন, আমি আসলে ৯৯৯ পন্থায় চেষ্টা করেছি। আর ১০০০ বারে সঠিক পথ পেয়ে গেছি। ঠিক ডাইসন এভাবেই নিজেকে ভ্যাকুয়াম ক্লীনার্স এর কাজে সফল পথ খুঁজে পান, তবে অনেক চেষ্টার পর। আর এখন তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনীর একজন।

৪) স্টিভ জবসঃ

সম্পদের পরিমানঃ ১০২ কোটি ডলার

 রিচার্ড ব্রানসন - ভার্জিন

রিচার্ড ব্রানসন ছিলেন ব্যর্থদের সর্বোত্তম  উদহারন। তিনি ব্যর্থ হতে হতে এতটা পথ হেঁটেছেন যে তিনি যে সফল হতে পারবেন এটা কল্পনা করা কঠিন ছিল।

ব্যর্থতাঃ

ভার্জিন গ্রুপের এই রিচার্ড ব্রানসন প্রথমে মাত্র ১৬ বছর বয়সে একটি ম্যাগাজিন বের করেন। যা তাঁর জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়। কিছু অহেতুক ঘটনার জন্য তাঁকে কারাবাস করতে হয়। তবে তিনি থেমে থাকতে পছন্দ করতেন না। নিজেকে গড়তে অনেক রকম চেষ্টা তিনি চালিয়ে যান। কিন্তু তিনি সফলতা নামক বস্তুকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না যেন।

সফলতাঃ

রিচার্ড ব্রানসনের সফলতাটা একটু বেশি ভিন্ন ছিল। তিনি অনেক শ্রমের পর আজকের এই অবস্থান তৈরি করেন। তার ভাষায়, ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিন এবং কাজ চালিয়ে যান অবিরত।

------------------------------------------------------------------

বিশ্বখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিনে সফল ব্যক্তিদের মধ্যে পরিলক্ষিত ১২টি কমন বা সাধারণ গুণাবলির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সাফল্যের জন্য ক্ষুধার্ত? তাহলে নিচের তালিকাটি পড়ে নিতে পারেন। সফল ব্যক্তিরা সাধারণত-

১. সাহসিকতার সঙ্গে ব্যর্থ হন: ব্যর্থতা আসবেই। তা আপনি যতই গুণান্বিত হন না কেন। সফল মানুষরা এই সহজ সত্যটাকে মেনে নেন। তারা ব্যর্থতার ভেতর দিয়েই সাফল্যের অন্বেষণ চালিয়ে যান। যখন সাধারণ মানুষ হাল ছেড়ে দেন, তখনও তারা চেষ্টা চালিয়ে যান। একই ব্যর্থতার বৃত্তে জড়ান না বারবার । জীবন থেকে শিক্ষা নেন।

২. লক্ষ্য নির্ধারণ করেন: কেবলমাত্র ‘লং টার্ম’ গোল বা লক্ষ্য নয়, সফল ব্যক্তিরা  সচেতন হন ‘শর্ট টার্ম’ বা প্রাত্যহিক লক্ষ্য অর্জনে। প্রতিদিনকার বিন্দু বিন্দু জমিয়ে তারা তৈরি করে নিতে জানেন সিন্ধু।

৩. শুধুমাত্র ভাগ্যে বিশ্বাসী হন না: সাফল্য কদাচিৎ ভাগ্যের দান। যদিও সাফল্যে ভাগ্যের সহায়তা দরকার পড়ে। তবে একনিষ্ঠতা, শ্রম আর ঘামের মূল্যেই মূলত সাফল্য অর্জন করে নিতে হয়। অনেক সময় ভাগ্য বিরূপ হতেই পারে। তবে পরিশ্রম দিয়ে তা অতিক্রম করে ছিনিয়ে আনা যায় সাফল্য। সফলরা তা-ই করেন।

৪. পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখেন: সচেতন পর্যবেক্ষণ সার্বিক পরিস্থিতির পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরে। কোথায় কি ঘাটতি, তা পুরনে কি যা করণীয়; যা করণীয় তার সঠিক বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা এই সব কিছু বুঝতে পারা যায় সচেতন পর্যবেক্ষণে।  

৫. কাজে দেরি করেন না: সফল ব্যক্তিরা যে সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানেন, এমনটা নয়। তবে তারা যে কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তৎপর হন। ভয়ে কিংবা নিশ্চয়তার চিন্তায় পিছু হটেন না।

৬. দৃষ্টিপাত করেন সামগ্রিক চিত্রে: শুধু অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যৎ নয়, সফল ব্যক্তিরা চোখ রাখেন সার্বিক পরিস্থিতিতে। দেখতে চেষ্টা করেন সামগ্রিক ফলাফল। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ- এই তিনকে এক সুতোয় গেঁথে তৈরি করেন সাফল্যের বরমাল্য।

৭. নিজের প্রতি আস্থা রাখেন: সফল ব্যক্তিরা নিজের প্রতি আস্থাশীল হন। নিজের শক্তি এবং দুর্বলতার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল হন। নিজেকে দিয়ে কি সম্ভব আর কি সম্ভব না এ ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা থাকায় তারা সুসিদ্ধান্ত নিতে পারেন বেশিরভাগ সময়।

৮. নিবেদিত হন: লক্ষ্যের প্রতি আত্মনিয়োগ ব্যতীত সাফল্য অর্জন কঠিন। সবচেয়ে সফল মানুষেরা সবচেয়ে নিবেদিত-ও হন।

৯. সাবধানতা অবলম্বন করেন: সফল হতে হলে সাবধানতা প্রয়োজন। চোখ কান খোলা রেখে চারপাশের পরিবেশ বোঝার চেষ্টা না করার মানে হলো- সুযোগ হাতছাড়া করা। সফল ব্যক্তিরা সাবধানতার সঙ্গে শোনেন, ভাবেন ও বোঝেন।

১০. হাল ছাড়েন না: সফল ব্যক্তিরা হাল ছাড়েন না। তারা কি ব্যর্থ হন? অবশ্যই। তবে ব্যর্থতা এলেই তাদের জীবনীশক্তি ফুরিয়ে যায় না। প্রতিকূলতার মধ্যেও কাজ চালিয়ে যান।

১১. যোগাযোগে তুখোড় হন: সফল ব্যক্তিরা শাণিত যোগাযোগ দক্ষতার অধিকারী হন। সহজেই মানুষকে বুঝতে এবং বোঝাতে পারেন। সমঝোতায় পটু হন। বাচনভঙ্গিতে হন আত্মবিশ্বাসী।

১২. বিনয়ী হন: সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে অহঙ্কার চলে আসা ভালো না। অনেক সফল ব্যক্তির মধ্যে অহঙ্কারের ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না। তারা নিজের সীমাবদ্ধতা বোঝেন। বোঝেন অন্যেরটাও। ক্ষমা চাইতে জানেন। করতেও জানেন।

# তথ্য সংগ্রহ : ইন্টারনেট ও বিভিন্ন তথ্য সুত্র থেকে ।

- জাহিদ আহমেদ ও তার স্মৃতি পরিষদ ।


শুক্রবার, ২৮ আগস্ট, ২০২০

বাবার প্র‌ফেশন ছোট ব‌লে প‌রিচয় না দেয়াটা সন্তা‌নের জন্য সাহ‌সিকতার নয় বরং নির্বু‌দ্ধিতার এবং কল‌ঙ্কের

বাবার প্র‌ফেশন ছোট ব‌লে প‌রিচয় না দেয়াটা সন্তা‌নের জন্য সাহ‌সিকতার নয় বরং নির্বু‌দ্ধিতার এবং কল‌ঙ্কের -

আমা‌দের বাবা'রা যারা কষ্ট ক‌রে জীব‌নের সব‌চে‌য়ে ক‌ঠিন পথ পা‌ড়ি দি‌য়ে আমা‌দের‌কে বড় ক‌রে‌ছেন , সমা‌জে প্র‌তি‌ষ্ঠিত ক‌রে‌ছেন সেসব বাবা ও মা‌য়ে‌দের‌ কে আল্লাহ সুস্থ রাখুক , নেক হায়াৎ দান করুক।  

 হালাল ও প‌রিশ্র‌মের কোন কাজ ছোট নয় , ছোট নয় সে মানুষটা যি‌নি ঐ ছোট কাজ ক‌রে


আমা‌দের মত সন্তান‌দের বড় ক‌রে‌ছেন।

আমার বাবা'র কথা ন‌া ব‌লে পার‌ছিনা , তি‌নি সারাজীবন বি‌ভিন্ন প্রাই‌ভেট কোম্পা‌নি‌তে চাক‌রি ক‌রে সংসার চা‌লি‌য়ে‌ছেন। অামার বাবা মু‌ক্তি‌যোদ্ধা ছি‌লেন , তি‌নি মু‌ক্তিযু‌দ্ধের পর ইচ্ছে কর‌লে ঢাকা শহ‌রে নুনতম ১ টি ২ টি বা‌ড়ির মা‌লিক খুব সহ‌জেই হ‌তে পার‌তেন কিন্তু তি‌নি সততা , সত্যবা‌দিতা ও নৈ‌তিকতার কার‌ণে তা ক‌রেন‌নি ! ছোট্ট একটা ব্য‌ক্তিমা‌লিকানা‌ধিন কোম্পা‌নি‌তে চাকরি ক‌রে , নি‌জে‌কে ও আমার মা‌কে ক‌ষ্টে রে‌খে আমা‌কে ও আমার ছোট ভাই‌কে মানুষ করার চেষ্টা ক‌রে‌ছেন । 

আমি সেই মহান মানুষটা‌কে কিভা‌বে অব‌হেলা ক‌রি ? কিভা‌বে উনার কাজটা‌কে ছোট ক‌রে দে‌খি ? আমি আজ‌কে বাবা'র কার‌ণে যত বড় হ‌য়ে‌ছি অামার সা‌থে সা‌থে অামার বাবাও ঠিক তত বড় হ‌য়ে‌ছেন ! তাই অা‌মি  অারও বড় হ‌তে চাই , কেননা অামার বাবার প‌রিশ্রম ও মান‌সিকতা তা‌কে অা‌রো অ‌নেক বড় অবস্থা‌নে নি‌য়ে যাবার মতই। তাই অা‌মি সন্তান হিসা‌বে ম‌নে ক‌রি , বাবা রা কখনও সংসার চালা‌তে গি‌য়ে , সন্তান মানুষ কর‌তে যে‌য়ে য‌দি উৎভুত প‌রি‌স্থি‌তির কার‌ণে ছোট কাজ ক‌রেও থা‌কেন তাহ‌লে তার সে ছোট কাজ‌কেও অামা‌দের সম্মান করা উচিৎ।

# ‌লি‌ঙ্কে দেয়া ভি‌ডিও‌টি‌তে দেখা যা‌চ্ছে , পার‌ভেজ বাংলা‌দে‌শের একজন সং‌গিত শি‌ল্পি যার বাবা ছি‌লেন ঢাকার প্রেসক্লা‌বের (বিপ‌রি‌ত দি‌কে অবস্থান করা) টাই‌পিস্ট। তি‌নি তার ৫ সন্তান‌দের‌কে মানু‌ষের মত মানুষ ক‌রে‌ছেন তার ঐ টাইপি‌ষ্টের পরিশ্রমলব্ধ উপার্য‌নের সী‌মিত টাকায়। # 

পৃ‌থিবীর বিখ্যাত ও সফল ব্যা‌ক্তি‌দের বাবারা গ‌রিব ও ছোট কাজ কর‌তেন । যেমন আমে‌রিকারর প্রে‌সি‌ডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের বাবা মু‌চি ছি‌লেন , ভার‌তের প্রে‌সি‌ডেন্ট পরমানু বিঞ্জা‌নি এ পি জে কালা‌মের বাবাও গ‌রিব ছি‌লেন ।

তাই জীব‌নে চলার প‌থে বা অ‌ফি‌সে কিংবা স্কুল থে‌কে ভা‌র্সি‌টি‌তে যেকোন প‌রি‌স্থি‌তি‌তেই বাবার অস্বচ্ছলতা বা ছোট কাজের জন্য সন্তান হিসা‌বে নি‌জে‌কে হেয় বা দুর্বল ভাব‌তে নেই কেননা তা‌তে যেমন বাবার ভালবাসা ও কাজ ক‌রে অামা‌দের মানুষ করা‌কে ছোট করা হয় তেম‌নি যারা বো‌ঝেনা বা ছোট ভা‌বে তারা নি‌জেদের সং‌কির্ণতা‌কে ফু‌টি‌য়ে তো‌লে।


- জা‌হিদ আহ‌মেদ ও তার স্মৃ‌তি প‌রিষদ।

  ahmedzahid75@gmail.com

ভারত বাংলাদেশ : অভিন্ন নদী , পানি চুক্তি এবং অত:পর

ভারত  বাংলাদেশ :  অভিন্ন নদী , পানি চুক্তি এবং অত:পর 

বাংলা‌দেশ ভারত পাশাপা‌শি বন্ধু রাষ্ট্র হ‌লেও দু‌দে‌শের ম‌ধ্যে যে বিষয়গু‌লো নি‌য়ে মত পার্থক্য ও দ্বন্দ্ব দেখা দেয় তা‌দের ম‌ধ্যে আন্ত:সীমান্ত নদীর পা‌নি বন্টন নি‌য়ে বি‌রোধ অন্যতম ।

আন্তঃসীমান্ত নদী

আন্তঃসীমান্ত নদী (Trans-boundary Rivers)  আন্তঃসীমান্ত নদী বলতে সাধারণত সেসমস্ত নদীকে বুঝায় যেগুলি অন্তত এক বা একাধিক দেশের রাজনৈতিক সীমা অতিক্রম করে। এই সীমা একটি দেশের অভ্যন্তরস্থ বা আন্তর্জাতিক হতে পারে। বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী প্রায় ২৬০টি আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে।

বাংলাদেশে আন্তঃসীমান্ত নদীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত এবং মায়ানমার থেকে ৫৮টি গুরুত্বপূর্ণ নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। জলতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক উভয় দিক থেকেই এ নদীগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে যেমন নদীগুলি প্রচুর পরিমাণে পলি বহন করে এনে মোহনা এলাকায় নতুন নতুন ভূমি গঠন করছে, আবার এ পলির অংশবিশেষ নদীরতলদেশকে ভরাট করে তুলছে যা বন্যা সংঘটনের জন্য অনেকাংশে দায়ী। এ নদীগুলির উজান অঞ্চলের রাষ্ট্র দুটির অনেক সময়ই নদীর পানি বণ্টনের আন্তর্জাতিক রীতি মেনে না চলার কারণে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে ৫৫টি এরূপ নদী রয়েছে যার মধ্যে কেবল গঙ্গানদীর পানি বণ্টনের চুক্তি হয়েছে দু’টি দেশের মাঝে। বাংলাদেশ-ভারত গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৯৬ সনের ১২ ডিসেম্বর প্রতিবছর ৩১ জানুয়ারি হতে ৩১ মে এই সময়ে ফারাক্কায় প্রবাহিত পানির পরিমাপের ভিত্তিতে দু’টি দেশের মধ্যে পানিবণ্টন হবে বলে নির্ধারণ করা হয়। ৩০ বছর মেয়াদী এ চুক্তি নবায়িত হবে দু’টি দেশের সম্মতির প্রেক্ষিতে। ১৯৭২ সালে দু’টি দেশের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষাকারী ‘যৌথ নদী কমিশন’ প্রতিষ্ঠিত হয় এর কাজ হলো, সাধারণ নদীসমূহের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে কিভাবে দু’টি দেশই সর্বাধিক সুযোগসুবিধা নিতে পারে সে ব্যপারে দুটি দেশের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করা।

ছক

ক্রমিক নম্বর ভারত থেকে আগত নদী সীমান্তবর্তী জেলা

১. রায়মঙ্গল সাতক্ষীরা

২. ইছামতী-কালিন্দী সাতক্ষীরা

৩. বেতনা-কোদালিয়া যশোর

৪. ভৈরব-কপোতাক্ষ মেহেরপুর

৫. মাথাভাঙ্গা কুষ্টিয়া, মেহেরপুর

৬. গঙ্গা নবাবগঞ্জ

৭. পাগলা নবাবগঞ্জ

৮. আত্রাই দিনাজপুর ও নওগাঁ

৯. পুনর্ভবা দিনাজপুর ও নওগাঁ

১০. তেঁতুলিয়া দিনাজপুর

১১. টাংগন দিনাজপুর

১২. কুলিক বা কোকিল ঠাকুরগাঁও

১৩. নাগর ঠাকুরগাঁও

১৪. মহানন্দা পঞ্চগড়, নবাবগঞ্জ

১৫. ডাহুক পঞ্চগড়

১৬. করতোয়া পঞ্চগড়

১৭. তলমা পঞ্চগড়

১৮. ঘোড়ামারা পঞ্চগড় ও নিলফামারী

১৯. দিওনাই-যমুনেশ্বরী নিলফামারী

২০. বুড়িতিস্তা নিলফামারী

২১. তিস্তা নিলফামারী

২২. ধরলা লালমনিরহাট

২৩. দুধকুমার কুড়িগ্রাম

২৪. ব্রহ্মপুত্র কুড়িগ্রাম

২৫. জিঞ্জিরাম কুড়িগ্রাম

২৬. চিল্লাখালি শেরপুর

২৭. ভোগাই শেরপুর

২৮. সোমেশ্বরী নেত্রকোনা

২৯. দামালিয়া/যালুখালী সুনামগঞ্জ

৩০. নোয়াগাঙ সুনামগঞ্জ

৩১. উমিয়াম সুনামগঞ্জ

৩২. যদুকাটা সুনামগঞ্জ

৩৩. ধলা সিলেট

৩৪. পিয়াইন সিলেট

৩৫. শারি-গোয়াইন সিলেট

৩৬. সুরমা সিলেট

৩৭. কুশিয়ারা সিলেট

৩৮. সোনাই-বারদল সিলেট

৩৯. জুরি মৌলভীবাজার

৪০. মনু মৌলভীবাজার

৪১. ধলাই মৌলভীবাজার

৪২. লংলা মৌলভীবাজার

৪৩. খোয়াই হবিগঞ্জ

৪৪. সুতাং হবিগঞ্জ

৪৫. সোনাই হবিগঞ্জ

৪৬. হাওড়া ব্রাহ্মণবাড়ীয়া

৪৭. বিজনী ব্রাহ্মণবাড়ীয়া

৪৮. সালদা ব্রাহ্মণবাড়ীয়া

৪৯. গোমতী কুমিল্লা

৫০. কাকরাই-ডাকাতিয়া কুমিল্লা

৫১. সিলোনিয়া ফেনী

৫২. মুহুরী ফেনী

৫৩. ফেনী খাগড়াছড়ি

৫৪. কর্ণফুলি রাঙ্গামাটি

৫৫. নিতাই ময়মনসিংহ

মায়ানমার থেকে আগত নদী সীমান্তবর্তী জেলা

৫৬. সাংগু বান্দরবান

৫৭. মাতামুহুরী বান্দরবান

৫৮. নাফ কক্সবাজার

আন্তঃসীমান্ত নদীগুলির পানিবণ্টন ইস্যু নিয়ে প্রায়ই সীমান্তবর্তী রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ছোট থেকে বড় আকারের বিরোধ সৃষ্টি হয়ে থাকে। যদি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনো একক কর্তৃপক্ষের উপর এ ধরনের সংকট নিরসনের দায়ভার ন্যাস্ত থাকত তবে এ ধরনের আন্তর্জাতিক বিরোধের সমাধান অনেক সহজ হতো। কিন্তু আন্তঃসীমান্ত সম্পদসমূহের ব্যবহার সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কোনো আইন বা নিয়মনীতি থাকায় যে সমস্ত অঞ্চলে জনসংখ্যার চাপ এবং সম্পদের চাহিদা বেশী সে সমস্ত এলাকায় এ ধরনের বিরোধ লেগেই থাকে। 


যৌথ নদী কমিশন হচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়। ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান একটি বহুব্যাপী বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী, সহযোগিতা ও শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন।এই চুক্তি অনুযায়ী জলসম্পদ বণ্টন, সেচ, বন্যা ও ঘুর্ণিঝড় নিয়ন্ত্রণের মতো সাধারণ বিষয়গুলির জন্য একটি যৌথ নদী কমিশন গঠন করা হয়।এবং উক্ত চুক্তি অনুসারে পানিসম্পদ, সেচ, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় নিয়ন্ত্রণের জন্য সাধারণ আগ্রহ ও যৌথ ব্যবহারের উদ্দেশ্যে দুইটি দেশ একত্রে কাজ করার অঙ্গীকার করে। কমিশনের প্রতিবেদন ও পাঠ ১৯৭৫, ১৯৭৮ ও সবশেষে ১৯৯৬ সালের গঙ্গার জল বণ্টনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন চুক্তিতে উপনীত হতে সাহায্য করে।

ইতিহাস

বাংলাদেশ হিমালয় থেকে উৎসরিত ৩টি বৃহৎ নদীঃ গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার পলল দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে। এটি পৃথিবীর একটি অন্যতম বৃহৎ বদ্বীপ। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রায় ৪০৫টি নদী প্রবাহিত হচ্ছে। এ নদীগুলোর মধ্যে ৫৭টি হচ্ছে আন্তঃসীমান্ত নদী যার মধ্যে ৫৪টি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন এবং ৩টি বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মধ্যে অভিন্ন। আবহমানকাল ধরে নদীমাতৃক বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা আবর্তিত হচ্ছে এসকল নদীর পানিকে ঘিরে। এ তিনটি নদীর অববাহিকার মোট আয়তন প্রায় ১.৭২ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার, যার মাত্র ৭ শতাংশ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত। এসকল নদীর অন্যান্য অববাহিকাভূক্ত দেশ হচ্ছে ভারত, নেপাল, ভূটান ও চীন।

১৯৭২ সালের মার্চ মাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ও প্রজাতন্ত্রী ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের মধ্যে যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে দু’দেশের বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে অভিন্ন নদীর ব্যাপক জরিপ কার্যক্রম পরিচালন এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণের বিস্তারিত প্রকল্প প্রণয়ন ও প্রধান প্রধান নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ প্রকল্পের উপর সমীক্ষা পরিচালন, উভয় দেশের জনগণের পারস্পরিক সুবিধা অর্জনের লক্ষ্যে এতদাঞ্চলের পানি সম্পদের ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার এবং বাংলাদেশের সাথে ভারত সংলগ্ন এলাকায় পাওয়ার গ্রীড সংযোজনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য স্থায়ী ভিত্তিতে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন গঠিত হয়। উক্ত ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালের ২৪ নভেম্বর অংশগ্রহণকারী দুদেশের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত রেখে সর্বাধিক যৌথ ফলপ্রসূ প্রচেষ্টার মাধ্যমে অভিন্ন নদীসমূহ থেকে সর্বোচ্চ সুফল প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের স্ট্যাটিউট স্বাক্ষরিত হয়। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের বাংলাদেশ পক্ষের কাজ সম্পাদনে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংযুক্ত দপ্তর হিসেবে যৌথ নদী কমিশন, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা হয়।

ভিশন, মিশন ও কার্যাবলি

রূপকল্প (Vision)

টেকসই পানি নিরাপত্তার লক্ষ্যে আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বণ্টন ও যৌথ ব্যবস্থাপনা।

অভিলক্ষ্য (Mission)

আন্তঃসীমান্ত নদী অববাহিকাভূক্ত দেশ এর সাথে পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর এবং পানি সম্পদের যৌথ ব্যবস্থাপনা।

 কার্যাবলি (Function)

o আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি বণ্টন, যৌথ ব্যবস্থাপনা, বন্যা সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত বিনিময়, ভারতীয় এলাকায় প্রবাহ নিয়ন্ত্রণমূলক কার্যক্রম এবং সীমান্তবর্তী এলাকার বাঁধ ও নদীতীর সংরক্ষণমূলক কাজসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনার লক্ষ্যে ভারতের সাথে বৈঠক অনুষ্ঠান ও প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ।

o ১৯৯৬ সালের গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির আওতায় প্রতি বছর ১লা জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সময়কালে ভারতের ফারাক্কায় গঙ্গা নদীর যৌথ প্রবাহ পর্যবেক্ষণ ও পানি বণ্টন এবং বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ সেতুর নিকট যৌথ প্রবাহ পর্যবেক্ষণ সংশ্লিষ্ট সকল কার্যক্রম তত্ত্বাবধান।

o আন্তঃসীমান্ত নদী অববাহিকায় যৌথভাবে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি প্রশমন, পানি সম্পদের আহরণ ও উন্নয়ন, নেপালে প্রবাহ নিয়ন্ত্রণমূলক কার্যক্রম এবং গবেষণা ও কারিগরী সংক্রান্ত বিষয়ে নেপালের সাথে বৈঠক অনুষ্ঠান ও প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ।

o পানি সম্পদ ক্ষেত্রে সহযোগিতা, আন্তঃসীমান্ত নদী অববাহিকায় চীন কর্তৃক প্রবাহ নিয়ন্ত্রণমূলক কার্যক্রম, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বন্যা পূর্বাভাসের তথ্য-উপাত্ত বিনিময় ও সক্ষমতা বৃদ্ধি বিষয়ে আলোচনার জন্য চীনের সাথে বৈঠক অনুষ্ঠান ও প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ।

o যৌথ নদী কমিশন, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সেচ ও নিষ্কাশন কমিশন (ICID)-এর বাংলাদেশের সচিবালয় হিসেবে কাজ করে। এছাড়া এই কমিশন ইন্টার-ইসলামিক নেটওয়ার্ক ফর ওয়াটার রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট এন্ড ম্যানেজমেন্ট (INWRDAM) এবং ওআইসি (OIC) এর পানি সম্পর্কিত বাংলাদেশের ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে ।

আন্তর্জাতিক নদী আইন লঙ্ঘন

দুইয়ের অধিক স্বাধীন দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী ‘আন্তর্জাতিক নদী’ হিসেবে পরিচিত। এসব নদীর ওপর কোনো দেশের একক আধিপত্য থাকে না। এসকল নদী নিয়ে আন্তর্জাতিক আইনও রয়েছে। ১৯৬৬ সালের হেলসিংকি নিয়মাবলি অনুযায়ী, কোনো উজানের দেশ আন্তর্জাতিক নদীর ওপর ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কিছু (বাঁধ, ব্যারেজ, বিদ্যুৎকেন্দ্র, স্লুইজগেট) নির্মাণ করতে পারবে না যা ভাটির দেশের জন্য ক্ষতিকর। একইভাবে, ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের জলপ্রবাহ কনভেনশনেও বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক নদীকে এমনভাবে ব্যবহার করা যাবে না যাতে তা অন্য দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতি বা অসুবিধার সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিক নদী নিয়ে এত আইন থাকার পরেও সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত এর কিছুই মানছে না। আন্তর্জাতিক আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নদীগুলোর ওপর একের পর এক বাঁধ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার কারণে বাংলাদেশ তার ন্যায্য পানি পাচ্ছে না। ৫৪টি অভিন্ন নদীর মধ্যে ভারত বেশ কয়েকটি নদীতেই বাঁধ, ব্যারেজসহ বিভিন্নরকম স্থাপনা নির্মাণ করেছে। যা নিয়ে ভারতের বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী ও অ্যাকটিভিস্ট অরুন্ধুতী রায় থেকে শুরু সচেতন ভারতীয় বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজও বিভিন্নভাবে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। আমাদের নদীমাতৃক দেশের নদীর সংখ্যা ১২০০ থেকে কমতে কমতে এখন মাত্র ২৩০টি। গঙ্গা চুক্তির ২৫ বছর হতে চললেও আমরা আমাদের ন্যায্য পানির হিস্যা বুঝে পাইনি। এক ফারাক্কা বাঁধের কারণেই বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গিয়েছে ছোট-বড় প্রায় ২০টি নদী। এছাড়াও ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ এর মতো ভারত শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকে দিয়ে আমাদের খরার মুখে ফেলছে আবার বর্ষাকালে পানি ছেড়ে দিয়ে আমাদের হাজারো গ্রাম পানির নিচে ডুবিয়ে দিচ্ছে। যার কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছরই বর্ষাকালে ভয়ানক বন্যা ও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। আবার শুষ্ক মৌসুমে মরুকরণ দেখা দেয়।

গঙ্গার জল বণ্টন 

বাংলাদেশ ও ভারত রাষ্ট্রদ্বয়ের বৈদেশিক সম্পর্কের একটি দীর্ঘকালীন ইস্যু। এই ইস্যুটি উত্তর ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গা নদীর জলসম্পদের সঠিক বণ্টন ও উন্নয়ন সম্পর্কিত। সুদীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে গঙ্গার জল বণ্টন নিয়ে উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে বিবাদ উপস্থিত হয়েছে। একাধিক বৈদেশিক চুক্তি ও আলোচনা সত্ত্বেও এর কোনো সুষ্ঠু সমাধান সম্ভব হয়নি।

মানচিত্রে উত্তর ভারতে গঙ্গা নদীর উৎস থেকে বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত নদীর গতিপথ।

যদিও ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর নতুন দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এইচ. ডি. দেবেগৌড়া ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ একটি সামগ্রিক বৈদেশিক চুক্তি সাক্ষর করেন। এই চুক্তিটি ছিল বাংলাদেশকে ন্যূনতম জলসরাবরাহের গ্যারান্টি সহ ৩০ বছরের জলবণ্টন চুক্তি। উল্লেখ্য, গঙ্গার নিম্ন অববাহিকায় বাংলাদেশের অধিকার স্বীকৃত। 

পটভূমি

বাংলাদেশের নদী-মানচিত্র

উত্তর ভারতের সমভূমি থেকে নেমে এসে গঙ্গা নদী ভারত ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সীমান্ত ধরে ১২৯ কিলোমিটার এবং তারপর বাংলাদেশের মধ্যে ১১৩ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছে। মুর্শিদাবাদ জেলার ধুলিয়ানের কাছে গঙ্গার প্রথম শাখানদী ভাগীরথী উৎপন্ন হয়েছে। উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাঞ্চলে এই নদীই আবার হুগলি নদী নামে পরিচিত। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ফারাক্কা বাঁধ নির্মিত হয়। এই বাঁধ গঙ্গার জলের প্রবাহকে নিয়ন্ত্রিত করে এবং হুগলি নদীর নাব্যতা রক্ষার উদ্দেশ্যে কিছু পরিমাণ জল একটি ফিডার খালের সাহায্যে ভাগীরথী নদীর দিকে প্রবাহিত করা হতে থাকে।

বাংলাদেশে প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্রের বৃহত্তম শাখানদী যমুনা নদীর সঙ্গে মিলিত হবার পূর্বে গঙ্গা নদী পদ্মা নাম ধারণ করেছে। আরও ভাটিতে গঙ্গা ব্রহ্মপুত্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম শাখানদী মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়ে মেঘনা নাম ধারণ করেছে এবং মেঘনার মোহনায় প্রবেশ করেছে। ৩৫০ কিলোমিটার প্রস্থবিশিষ্ট এই মোহনার মাধ্যমে গঙ্গা বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। উল্লেখ্য, ভারত থেকে ৫৪টি নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

সমাধান প্রচেষ্টা

১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান একটি বহুব্যাপী বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী, সহযোগিতা ও শান্তিচুক্তি সাক্ষর করেন।[৪] এই চুক্তি অনুযায়ী জলসম্পদ বণ্টন, সেচ, বন্যা ও ঘুর্ণিঝড় নিয়ন্ত্রণের মতো সাধারণ বিষয়গুলির জন্য একটি যৌথ নদী কমিশন গঠন করা হয়।


ফারাক্কা বাঁধ

ফারাক্কা বাঁধ পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১০ কিলোমিটার (৬.২ মাইল) দূরে অবস্থিত একটি বাঁধ। এই বাঁধের মাধ্যমে ভারত গঙ্গার জল নিয়ন্ত্রিত করে থাকে। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে পলি জমে হুগলি নদীর নাব্যতা হ্রাস পেতে শুরু করলে কলকাতা বন্দর গভীর সমস্যার সম্মুখীন হয়। এই সমস্যা সমাধানে শুষ্ক মৌসুমে (জানুয়ারি-জুন মাস) গঙ্গার জল হুগলি নদীর অভিমুখে প্রবাহিত করে পলি দূর করার জন্য এই বাঁধ নির্মিত হয়। বাংলাদেশ দাবি করে, ভারতে এইভাবে নদীর জলপ্রবাহের অভিমুখ পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের নদীগুলি শুকিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭৪ সালের মে মাসে ফারাক্কা বাঁধ চালু করার আগে জলবণ্টন ইস্যুর সমাধানে একটি যৌথ ঘোষণাপত্র জারি করা হয়। এরপর ১৯৭৫ সালে একটি অন্তর্বর্তী চুক্তির মাধ্যমে ভারত স্বল্পমেয়াদের জন্য বাঁধের ফিডার খালটি চালু করার অনুমতি পায়। 

অবশ্য, শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ড ও বাংলাদেশে সেনাশাসন প্রতিষ্ঠার পর দুই রাষ্ট্রের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হলে ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারত সকল প্রকার আলাপ-আলোচনা বন্ধ করে দেয়। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের একটি শীর্ষ সম্মেলনে এবং ৩১তম জাতিসংঘ সাধারণ সভার বৈঠকে ভারতে একতরফা পদক্ষেপের প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ।  অন্যান্য রাষ্ট্র ও জাতিসংঘের পরামর্শক্রমে ভারত ও বাংলাদেশ পুনরায় আলোচনা শুরু করলেও, তা থেকে কোনো সমাধানসূত্র পাওয়া সম্ভব হয় না।


সাময়িক চুক্তি সম্পাদন

১৯৭৭ সালে ভারতের তদনীন্তন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই ও বাংলাদেশের তদনীন্তন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনকালে দুদেশের বৈদেশিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। উক্ত দুই নেতা সেই বছর একটি পাঁচ বছরের জলবণ্টন চুক্তি সাক্ষর করেন। কিন্তু ১৯৮২ সালে সেই চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর তার আর পুনর্নবীকরণ করা হয়নি। 

১৯৮২ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশের তদনীন্তন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ ভারতের সঙ্গে দুই বছরের জলবণ্টন নিয়ে একটি মেমোরান্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং (মউ) সাক্ষর করেন। ১৯৮৫ সালের ২২ নভেম্বর আরও একটি মউ সাক্ষরিত হয়।  তবে প্রবাহিত জলের পরিমাপ বৃদ্ধি নিয়ে কোনো চুক্তি সাক্ষরিত হয়নি। ভারতও চুক্তি সম্প্রসারিত করতে অস্বীকার করে। ১৯৯৩ সালের শুখা মরশুমে বাংলাদেশের দিকে জলপ্রবাহ পূর্বের ৩৪,৫০০ কিউসেকের বদলে কমিয়ে ১০,০০০ কিউসেক করে দেওয়া হয়।[২] বাংলাদেশ জাতিসংঘ সাধারণ সভা এবং সাউথ এশিয়ান এসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কো-অপারেশনে (সার্ক) বিষয়টি আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নীত করতে চেষ্টা করে। কিন্তু তাতেও বিশেষ ফল হয় না।


১৯৯৬ সালের চুক্তি সম্পাদন

 

ভারত ও বাংলাদেশে গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চল

১৯৯৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা ওয়াজেদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হলে দুই দেশের বৈদেশিক সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধিত হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর উভয় দেশের নেতৃত্ব নতুন দিল্লিতে মিলিত হয়ে একটি ৩০ বছরের সামগ্রিক চুক্তি সাক্ষর করেন। এই চুক্তি অনুযায়ী ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ফারাক্কা থেকে দুই দেশের মধ্যে জল বণ্টন করা হতে থাকে। পূর্ববর্তী ৪০ বছরের গড় মাত্রা অনুযায়ী ভারত গঙ্গার জলের ভাগ পেতে থাকে। যে কোনো সংকটের সময় বাংলাদেশকে ৩৫,০০০ কিউসেক জল সরবরাহ করার গ্যারান্টিও দেওয়া হয়।

গঙ্গার জলের দীর্ঘকালীন বণ্টনব্যবস্থা ও অন্যান্য সাধারণ নদীগুলি ক্ষেত্রে একই রকমের জলবণ্টন ব্যবস্থা কার্যকরী করার জন্যও উভয় দেশের মধ্যে চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির ফলে ভারতের গঙ্গার জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ এবং গঙ্গার নিম্ন অববাহিকায় বাংলাদেশের অধিকার সহ জলের সমান ভাগ পাওয়ার অধিকার – দুইই প্রতিষ্ঠিত হয়। উভয় রাষ্ট্রই জলসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা সুনিশ্চিত করার কথা বলে। এই চুক্তির ফলে কুষ্ঠিয়া ও গড়াই-মধুমতী নদীর উপর বাঁধ ও সেচপ্রকল্প পারমিট পায়। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলিতে জল সরবরাহ এবং বঙ্গোপসাগরের লবনাক্ত জলের প্রকোপ থেকে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যকে রক্ষা করা।


বাংলাদেশের ক্ষতি সাধন 

শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি অপসারণের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে বাংলাদেশকে কৃষি, মৎস্য, বনজ, শিল্প, নৌ পরিবহন, পানি সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হতে হয়। প্রত্যক্ষ ভাবে বাংলাদেশের প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়; যদি পরোক্ষ হিসাব করা হয়, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হবে। প্রফেসর এম, আই চৌধুরী এবংসৈয়দ সফিউল্লাহ জাতিসংঘ পরিবেশ অধিদপ্তর ও হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘গ্লোবাল কার্বন প্রবাহ’ গবেষণা প্রকল্পে বিভিন্ন গুরত্বপুরন তথ্য উঠে আসে । ৮ বছরের সমীক্ষার ফলাফল সংক্ষেপে নিম্নোরূপ :

1. পদ্মা নদী দিয়ে পলিপ্রবাহ প্রায় ২০% কমে গেছে (১৯৬০ সালের তুলনায়)।

2. কার্বন প্রবাহ কমেছে ৩০%।

3. পলিপ্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে জমির উর্বরা শক্তি কমে যাচ্ছে।

4. মিনারেল এবং নিউট্রিয়েন্ট কমে যাওয়ার ফলে নদী ও জলাভূমিতে ফাইটোপ্লাকটন উৎপাদন কমেছে ৩০%। ফাইটোপ্লাকটন হচ্ছে খাদ্য চক্রের প্রথম ধাপ। এ থেকে ক্রমান্বয়ে মাছ ও অন্যান্য জলজ জীবের উৎপাদন ঘটে। পদ্মা-ব্রক্ষপুত্রের সঙ্গমস্থল আরিচাঘাটে সমীক্ষা থেকে যে ফিশ ক্যালেন্ডার তৈরী করা হয়েছে তাতে দেখা যায় ৩৫ বছর আগের তুলনায় বর্তমান মৎস্য উৎপাদন মাত্র ২৫%। ইলিশ মাছ এখানে পাওয়া যায় না বল্লেই চলে। ইলিশ মাছ স্যাড গোত্রীয় মাছ। ০-৪২০ বিষ্ণুরেখার যেখানেই সমূদ্র সংলগ্ন নদী রয়েছে সেখানেই এই মাছ পাওয়া যায়। বৎসরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে এই মাছ নোনা পানি থেকে মিঠা পানিতে আসে ডিম পাড়ার জন্য। উজানে এদের আগমন বাঁধ কিম্বা ঐ ধরনের বাধার পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত সংবেদনশলীল। ফারাক্কার আগে এক সময় রাজশাহী পদ্মা অবধি ইলিশ মাছ পাওয়া যেত। এখন আরিচাতেই এ মাছ পাওয়া যায় না। ফারাক্কা বিদ্যমান থাকলে আশংকা করা হয় পদ্মা এবং তার কমান্ড অঞ্চলে ইলিশ মাছ আদৌ পাওয়া যাবে না।

5. জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে সমুদ্রের পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দুধারী তলোয়ারের মত কাজ করছে। একদিকে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূল অঞ্চল তলিয়ে যাওয়া আর তার সাথে যোগ হয়েছে বাংলাদেশের সমতল ভূমির ক্রমান্বয়ে দেবে যাওয়া যাকে বলা হয় সাবসিডেন্স। এর হার বছরে ৫ মি.মি.। নদীর প্লাবনের কারণে সঞ্চিত পলি সাবসিডেনসের নেতিবাচক প্রভাবকে এতকাল পুষিয়ে নিয়ে আসছিল। ফারাক্কার কারণে এমনটি আর হতে পারছে না ।

6. টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর টোশিও ইসুজুকা ও আমাদের যৌথ গবেষণায় ষ্ট্রনসিয়াম আইসোটপ সমীক্ষার মাধ্যমে দেখা গেছে যে পুরো বঙ্গোপসাগর জুড়ে সময় অনুচক্রে তীব্র ফাইটোপ্লাকটন বিকাশ ঘটে। আর এর অনুঘটক হচ্ছে নদী বাহিত নিউট্রিয়েন্ট বা পুষ্টি উপাদান ও মিনারেল। ফারাক্কা বাঁধের কারণে প্রক্রিয়াটি বিঘ্নিত হচ্ছে। ফলে সমগ্র বঙ্গোপসাগর জুড়ে মৎস্য উৎপাদন আশংকাজনকভাবে কমে যেতে পারে। বঙ্গোপসাগরের মাছের উপর ভারতের বিপুল জনগোষ্ঠিও নির্ভরশীল।একই সাথে কার্বন প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার উপশম কম হবে

7. প্রফেসর কেট ক্র্যান্ক (কানাডা) এর সাথে যৌথ গবেষণায় দেখা যায় যে ফারাক্কার কারণে নদী বাহিত পলির গ্রেইন সাইজ স্পেকট্রাল প্যার্টান অর্থাৎ পলি কণার সাইজ এর তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিবর্তন বাংলাদেশের মাটির ভৌত কাঠামোর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে ।[৬]

বিস্তৃত অঞ্চল মরুকরণসম্পাদনা

পদ্মার পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের উত্তর অববাহিকায় বিশেষ করে রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ ভূগর্ভস্থ পানির প্রথম স্তর ৮-১০ ফুট জায়গা বিশেষে ১৫ ফুট নিচে নেমে গেছে। । মওসুমী বৃষ্টি ও এই স্তরে রিচার্য করে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। সেচের জন্য খরার মৌসুমে এখন ভরসা দ্বিতীয় স্তর (>৩০০ ফুট)। বরেন্দ্র অঞ্চলে এই স্তরটা মোটামুটি ফসিল পানি দিয়ে পূর্ণ। ব্যাপক সেচের ফলে এই স্তর থেকে কতদিন পানি উত্তোলন করা যাবে কে জানে। পানির অভাবে মাটির আদ্রতা শুষ্ক মওসুমে ৩৫% কমে গেছে। পানি প্রবাহের এমন করুণ অবস্থা থেকে সৃষ্ট হয় মরুকরণ প্রক্রিয়া। নদীর পানি থেকে জলীয় বাষ্প সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বায়ুর আদ্রতা সৃষ্টিতে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। খরার সময় পদ্মা নিজেই যখন বিশুষ্ক মরুভূমিতে পরিণত হয় সে তখন স্থলভূমির বায়ুতে আদ্রতার যোগান কিভাবে দিবে। আদ্রতার অভাবে দিনের নিম্নতম এবং উচ্চতম তাপমাত্রার তারতম্য বৃদ্ধি পায়। ৬০ দশকে এই তারতম্য যেখানে ৫-৮ সে. ছিল এখন সেটা বৃদ্ধি পেয়ে ৮-১২ সে. এ দাঁড়িয়েছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে মরুকরণ প্রক্রিয়ার ব্যাহিক রূপ এই অঞ্চলের জনগণ ইতিমধ্যে প্রত্যক্ষ করছেন। মরুকরণের অনেক বায়ো মার্কার রয়েছে, এইগুলো হতে পারে পানি নির্ভর উদ্ভিদ এবং আরো সুক্ষ স্তরে অণুজীব। আশা করা যায় দেশের নতুন প্রজন্মের পরিবেশ বিজ্ঞানীরা জাতীয় স্বার্থে এ ব্যাপারে গবেষণায় ব্রত হবেন।

নদীর নাব্যতা সম্পাদন

ফারাক্কা পরবর্তি সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গঙা নদীর (পদ্মা) প্রবাহে চরম বিপর্যয় ঘটে। প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীর নাব্যতা কমে যায়। ফলে প্রায় বাংলাদেশর বর্তমানে প্রায়ই বড় বন্যা সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বাংলাদেশের গড়াই নদী এখন সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত।

মাটির লবণাক্ততা সম্পাদন

ফারাক্কা বাঁধের ফলে বাংলাদেশের খুলনা অঞ্চলের মাটির লবনাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞানীরা খুলনার রুপসা নদীর পানিতে ৫৬৩.৭৫ মিলিগ্রাম/লিটার ক্লোরাইড আয়নের উপস্থিতি পেয়েছেন। তাছাড়া, মিঠা পানির সরবরাহ কমে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে লবন, ভূ-অভ্যন্তরস্থ পানিতে প্রবেশ করছে।

কৃষি সম্পাদন

কৃষির অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। পানির স্তর অনেক নেমে যাওয়ার দক্ষিণ অঞ্চলের জি-কে সেচ প্রকল্প মারাত্বক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সেচযন্ত্র গুলো হয়ত বন্ধ হয়ে আছে অথবা সেগুলোর উপর তার ক্ষমতার চাইতে বেশি চাপ পড়ছে। এই প্রকল্পের অন্তর্গত প্রায় ১২১,৪১০ হেক্টর জমি রয়েছে। মাটির আর্দ্রতা, লবনাক্ততা, মিঠা পানির অপ্রাপ্যতা কৃষির মারাত্বক ক্ষতি করেছে।

মৎস্য সম্পাদন

পানি অপসারণের ফলে পদ্মা ও এর শাখা-প্রশাখাগুলোর প্রবাহের ধরন, পানি প্রবাহের বেগ, মোট দ্রবীভূত পদার্থ (Total dissolved solids) এবং লবণাক্ততার পরিবর্তন ঘটেছে। এই বিষয় গুলো মাছের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গঙ্গার পানির উপর এই এলাকার প্রায় দুই শতেরও বেশি মাছের প্রজাতি ও ১৮ প্রজাতির চিংড়ী নির্ভর করে। ফারাক্কা বাঁধের জন্য মাছের সরবরাহ কমে যায় এবং কয়েক হাজার জেলে বেকার হয়ে পড়েন।

নৌ-পরিবহনসম্পাদনা

শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের ৩২০ কিলোমিটারের বেশি নৌপথ নৌ-চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে, কয়েক হাজার লোক বেকার হয়ে পড়ে, নৌ-পরিবহনের খরচ বেড়ে যায়।

ভূ-অভ্যন্তরে পানির স্তরসম্পাদনা

ভূ-অভ্যন্তরের পানির স্তর বেশিরভাগ জায়গায়ই ৩ মিটারের বেশি কমে গেছে। তাছাড়া বিভিন্ন দ্রবিভুত পদার্থের , ক্লোরাইড, সালফেট ইত্যাদির ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার কারণেও পানির স্তর কমছে। এর প্রভাব পড়ছে কৃষি, শিল্প, পানি সরবরাহ ইত্যাদির উপর। মানুষের বাধ্য হয়ে ১২০০ মিলিগ্রাম/লিটার দ্রবিভুত পদার্থ সম্পন্ন পানি পান করছে। যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO = World health organization) ৫০০ মিলিগ্রাম/লিটারের কম দ্রবীভূত পদার্থ সম্পন্ন পানিকেই মানুষের পান করার জন্য উপযুক্ত বলে ঘোষণা করেছে।

ভারতের ক্ষতিসম্পাদনা

একচল্লিশ বছর আগে গঙ্গার উপর যখন ফারাক্কা বাঁধ চালু করা হয়, তার একটা প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জলপ্রবাহের একটা অংশকে হুগলী নদীতে চালিত করে কলকাতা বন্দরকে পুনরুজ্জীবিত করা।সে উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল না-হলেও ফারাক্কার জেরে গঙ্গার উজানে যে পলি পড়া শুরু হয়েছে, তারে জেরে প্রতি বছরই বর্ষার মরশুমে বন্যাকবলিত হয়ে পড়ছে বিহার ও উত্তরপ্রদেশের একটা বিস্তীর্ণ অংশ।। বহুদিন ধরেই মালদহ-মুর্শিদাবাদ জেলার গঙ্গা তীরবর্তী দুর্ভোগ ও বিপর্যয়কবলিত মানুষ ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে আসছে। একই সঙ্গে তারা ক্ষতিপূরণ, ভূমি ও পুনর্বাসন দাবি করে আসছে। অব্যাহত বন্যা ও নদীভাঙন প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণেরও তারা দাবি জানিয়ে আসছে। বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গের জন্যও ফারাক্কা বাঁধ বড় রকমের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, পার্শ্ববর্তী বিহারও ফারাক্কা বাঁধের কারণে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। সেখানে চলমান বন্যায় ১০ লাখের বেশি মানুষ ও ২ লাখ মানুষের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিহার রাজ্য সরকারের দাবি, ফারাক্কা বাঁধের কারণেই এই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং প্রায় প্রতিবছরই রাজ্য বন্যা ও নদীভাঙনের শিকার হচ্ছে। 

তিস্তা প্রকল্পে চীনা বিনিয়োগ, ‘দুশ্চিন্তায়’পররাষ্ট্র স‌চিব শ্রিংলাকে ঢাকায় পাঠালো ভারত

অনির্ধারিত এক ঝটিকা সফরে ঢাকায় এসেছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। গত ১৮ আগস্ট, মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকায় পৌঁছান তিনি। এই সফর নিয়ে বাংলাদেশ সরকার কিছু না বলেও দেশে মেগা প্রকল্পে চীনা বিনিয়োগের প্রেক্ষাপটে শ্রিংলার এই বলে জানিয়ে ভারতের গণমাধ্যম।

‘চায়নাস তিস্তা প্লানস: ফরেন সেক্রেটারি লাইকলি টু ভিজিট বাংলাদেশ টুডে’ শিরোনামে এমন খবর প্রকাশ করেছে ভারতের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু।

এতে বাংলাদেশের তিস্তা নির্ভর সেচ বা কৃষি প্রকল্পে চীন ১০০ কোটি ডলার সহায়তা করবে বলেও ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন কল্লোল ভট্টাচার্য।   

ওই প্রতিবেদনে কল্লোল ভট্টাচার্য লিখেছেন, তিস্তায় সেচ প্রকল্পে চীনের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলারের সহায়তা পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ভারতের সঙ্গে পানিবন্টন বিষয়ক সমঝোতার কেন্দ্রে রয়েছে এই তিস্তা। এই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে গ্রীষ্ম মৌসুমে তিস্তায় পানির লেভেল আশানুরূপ পর্যায়ে রাখতে সহায়ক হবে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ভারতের সঙ্গে পানি বন্টন চুক্তি সম্পাদন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে ব্যর্থতার পর চীনের সঙ্গে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে বাংলাদেশ সরকারের সূত্রগুলো অনলাইন ইউরেশিয়া ভিউ’কে জানিয়েছেন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেসব চ্যালেঞ্জ আসছে তাকে সামনে রেখে মঙ্গলবার এক দিনের জন্য ঢাকা সফরে আসছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। আর এই সঙ্গে ওই ইস্যুগুলো সামনে চলে এসেছে।

ইউরেশিয়াভিউ’র বরাত দিয়ে ওই প্রতিবেদেন বলা হয়, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা রংপুরে ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট এন্ড রিস্টোরেশন প্রকল্প’ বাস্তবায়নে ৮৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার চেয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। দিল্লি ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে রাজনৈতিক লড়াইয়ে তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি আটকে আছে। এক্ষেত্রে চীনের এই ঋণ হবে সম্পর্কের ‘ল্যান্ডমার্ক’, কারণ, এতে ভারত-বাংলাদেশ তিস্তার পানি বন্টন চুক্তির পরিণতিকে সিল করে দেবে।

আরো বলা হয়, তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত একটি বিশাল প্রজেক্টে চীনের অর্থায়ন মেনে নেয়া হয়েছে। এতে অর্থ সহায়তা দিতে রাজি হয়েছে চীন। বাংলাদেশি সংবাদ মাধ্যমকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জ্যোতি প্রসাদ ঘোষ বলেন, আশা করছি ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা এই প্রকল্প শুরু করতে পারবো।

দ্য হিন্দু আরো জানায়, ডিসেম্বর ও মে মাসে তিস্তা নদীতে পানির স্তর বেশি রাখার জন্য বৃহত্তর একটি শেয়ার দাবি করছে বাংলাদেশ। এ সময়ে পানির স্তর শুকিয়ে যায়। ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে কৃষিকাজ কঠিন হয়ে পড়ে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বার বার উদ্যোগ নেয়া সত্ত্বেও এই তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি ব্যর্থ হয়েছে। ফলে ভারত সরকার তার প্রতিশ্রুত এই ‘ল্যান্ডমার্ক চুক্তি’কে সামনে এগিয়ে নিতে পারেনি।

তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশে নদীটির বিস্তৃত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুজ্জীবনে একটি প্রকল্প হাতে নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।

'তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট এন্ড রেস্টোরেশন' নামে এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে আনুমানিক আট হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক এ.এম. আমিনুল হক এই তথ্য জানিয়েছেন।

প্রকল্পটি চীনের ঋণ সহায়তায় পরিচালিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে চীন তিস্তা নদীতে কি ধরণের প্রকল্প হতে পারে সে বিষয়ে প্রাথমিকভাবে ধারণা নেয়ার জন্য জরিপ পরিচালনা করেছে বলে জানা যায়।

এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক মি. হক বলেন, "চাইনিজদের সাথে যেটা সেটা হচ্ছে ওরাই স্টাডি-টা করেছে নিজেদের খরচে। আমরা ইআরডিকে জানিয়েছি যে অর্থায়নের ব্যাপারে বিদেশি সহায়তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এখন চাইনিজরা যদি ইআরডির সাথে যোগাযোগ করে আগ্রহ প্রকাশ করে তাহলে হয়তো এটা আগাবে।"

বর্তমানে পরিকল্পনাটি ইআরডির আওতায় রয়েছে বলেও জানান তিনি।

ভারত থেকে বাংলাদেশে যে ৫৪টি নদী প্রবেশ করেছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে তিস্তা। এটি ভারতের সোলামো লেক থেকে উৎপন্ন হওয়ার পর সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রংপুর জেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পরে এটি চিলমারির কাছে ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে মিলিত হয়েছে।

বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেইজিং সফরের সময় রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি আরো কয়েকটি বিষয়ে চীনের সহায়তা চেয়েছিলেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ডেল্টা প্ল্যান ২১০০, ক্লাইমেট অ্যাডাপটেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা এবং তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট এন্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট। সেই সফরে চীন আশ্বাস দেয় যে তারা জলবায়ু অভিযোজন বিষয়ক কেন্দ্র এবং তিস্তা প্রকল্পে অর্থায়ন করবে দেশটি।

এ বিষয়ে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ.কে.এম. এনামুল হক শামীম বলেন, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ ২১টি প্রস্তাব দাতা দেশগুলোর সাথে তুলে ধরে। এরমধ্যে তিস্তার এই প্রকল্পটির প্রস্তাবনাও ছিল।

পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক জানান, ছয় মাস আগে এ ধরণের কয়েকটি প্রকল্প দাতা দেশগুলোর সামনে তুলে ধরা হয়েছিল। সেখানে তিস্তার প্রকল্পটির বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছিল চীন।

এখন অর্থায়নের বিষয়টি পুরোপুরি নির্ধারণ করবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ - ইআরডি।

তিনি বলেন, "আমরা প্রকল্প দিয়েছি, চীন আগ্রহ দেখিয়েছে, তারা ইআরডির সাথে যোগাযোগ করবে এবং ইআরডিও তাদের সাথে যোগাযোগ করবে। এটা এখন ইআরডি-তে আছে।"

তবে ইআরডি বলছে যে প্রকল্পটির অর্থায়ন নিয়ে এখনো চীনের সাথে প্রাথমিক আলোচনা শুরু হয়নি। তারা পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রস্তাব পেয়েছে মাত্র।

এ বিষয় ইআরডি-এর অতিরিক্ত সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী বলেন, "আমরা সবেমাত্র পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে প্রাথমিকভাবে একটি প্রস্তাবনা পেয়েছি। এটা প্রস্তুত হতে আরো অনেক সময় লাগবে।"

"আমরা আসলে প্রাথমিক পর্যায়েও যেতে পারিনি এখনো। এটা নিয়ে আলোচনা করবো চীনের সাথে, সেটাও করি নাই এখনো।"

কী থাকবে তিস্তা বিষয়ক প্রকল্পটিতে?

ধারণা করা হচ্ছে যে, এই প্রকল্পটিতে তিস্তার উপকূল ব্যবস্থাপনা বিষয়ক নানা অবকাঠামো নির্মাণ ছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং গ্রীষ্মকালে পানি সংকট দূর করতে বিভিন্ন ধরণের অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বিরোধিতারসহ নানা কারণে তিস্তা সমস্যার কোন সমাধান এখনো হয়নি।
ছবির ক্যাপশান,

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বিরোধিতারসহ নানা কারণে তিস্তা সমস্যার কোন সমাধান এখনো হয়নি।

ভারতের সাথে বাংলাদেশের যেহেতু তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে দীর্ঘদিনের যে দ্বন্দ্ব রয়েছে সেটি কাটিয়ে শুকনো মৌসুমে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা হবে।

এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক বলেন, প্রকল্পটিতে এখনো পর্যন্ত যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে তার মধ্যে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ।

এগুলো হচ্ছে নদীগর্ভে ড্রেজিং করা, রিভেটমেন্ট বা পাড় সংস্কার ও বাধানো এবং ভূমি পুনরুদ্ধার।

এছাড়া বন্যা বাঁধ মেরামতেরও পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের অ্যাডিশনাল চিফ ইঞ্জিনিয়ার জ্যোতি প্রসাদ ঘোষ বলেন, তিস্তা রেস্টোরেশন প্রকল্পে যে বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পাড় বাধানো ও সংস্কার, নদীর বিস্তৃতি একটি সুনির্দিষ্ট পরিমাপে আনা এবং ভূমি পুনরুদ্ধার।

"তিস্তার বিস্তৃতি কোন এলাকায় হয়তো পাঁচ কিলোমিটার, কোথাও দেড় কিলোমিটার বা কোথাও তিন কিলোমিটার আছে। সেক্ষেত্রে এই বিস্তৃতি কমিয়ে দেড় বা দুই কিলোমিটার কিংবা প্রকল্পের নকশায় যা আছে সে অনুযায়ী করা হবে।"

তিনি বলেন, এর ফলে তিস্তার পারে থাকা শত শত একর জমি বা ভূমি পুনরুদ্ধার হবে যা ভূমিহীন মানুষ কিংবা শিল্পায়নের কাজে লাগানো হবে।

সেই সাথে ড্রেজিং করে নদীর গভীরতা বাড়ানো হবে বলেও জানান তিনি।

তিনি বলেন, গভীরতা বাড়িয়ে এবং বিস্তৃতি কমিয়ে যদি একই পরিমাণ পানির প্রবাহ ঠিক রাখা যায় তাহলে নদীর পাড়ের জমি উদ্ধার করা সম্ভব হবে।

এছাড়া তিস্তা নদীতে যাতে ভাঙন রোধ করা যায় সে বিষয়েও পরিকল্পনা রয়েছে।

তিস্তা চুক্তির অবস্থা কী

গত ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় তিস্তা চুক্তি সই হওয়ার ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার মুখে তা আটকে যায়।

এরপর ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পরের বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে বাংলাদেশ সফর করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেখানে তিনি আশ্বস্ত করেন যে তিস্তার পান ভাগাভাগি নিয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো হবে।

কিন্তু এর পর পাঁচ বছর পার হয়ে গেলেও তিস্তা সমস্যার কোন সমাধান এখনো হয়নি।

সবশেষ ২০১৯ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে মীমাংসা আসার সম্ভাবনা থাকলেও সেটি হয়নি।

তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়া এবং দ্বিপাক্ষিক কিছু ইস্যুতে ভারতের ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশে এক ধরণের হতাশা রয়েছে।

এমন অবস্থায় তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভারতের আশায় বসে না থেকে বাংলাদেশ নিজ থেকে উদ্যোগ নিচ্ছে কিনা এমন প্রশ্ন করা হলে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ.কে.এম. এনামুল হক শামীম বলেন, এই পরিকল্পনাটি এখনো খুবই প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে। এটি নিয়ে মন্তব্য করার সময় আসেনি।

এদিকে প্রকল্পটির বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রুকসানা কিবরিয়া বলেন, চীনই আসলে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ থেকেই তিস্তা প্রকল্পের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে।

তিনি বলেন, প্রকল্পটি চীনের সহায়তায় হচ্ছে। কিন্তু প্রকল্পের অর্থায়নের এক বিলিয়ন ডলার কিন্তু বাংলাদেশকে সহায়তা হিসেবে নয় বরং ঋণ হিসেবে দেয়ার কথা রয়েছে। যা বাণিজ্যিক সুদের হার মিলিয়ে ফেরত দিতে হবে।

এই অর্থ ফেরত দিতে না পারলে কি ধরণের পরিণতি হতে পারে সে বিষয়টিও ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে বলে মনে করেন রুকসানা কিবরিয়া।

তবে চীনের এই সহায়তার বিষয়টি ভারত খুব ভালভাবে নেবে না বলেও মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই শিক্ষক।

# তথ্য সুত্র :বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমসহ ওয়েব#

- জাহিদ আহমেদ ও তার স্মৃতি পরিষদ।

ahmedzahid75@gmail.com

ইসলামিক /মুসলিম দেশে যত সব ভাস্কর্য / মুর্তি

 ইসলাম‌িক  বা মুসলিম দেশে যত সব ভাস্কর্য / মুর্তি  --------------------------------------------------------------- পা‌কিস্তান , সৌ‌দি আর‌ব ...